কয়েক দিন পর, আট জনে  বজরা সাজিয়ে বেরিয়ে পড়ে, জঙ্গল ভ্রমণে    
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, হরিণের দল, বানর, পাখির দেখা মেলে নানা স্থানে    
সন্ধ্যা হয় হয়; বজরা চলছে ধীরে,  হটাতই হাড় হিম করা গর্জন আসে কানে
মুখ চাওয়া-চায়ি করে বন্ধুরা, নিধি বলে; ঝড়ো এগোও, নোঙর করো না একেনে    
দুপারেই জঙ্গল, নিঃসীম নিস্তব্ধ চরাচর, দু-একটা পাখির ডাক, জলের শব্দ জাগে  
আরো অনেকটা এগিয়ে নোঙর করে ঝড়ো, এক আদিবাসী বন-বস্তির আগে
রাতের আকাশ জুড়ে তারার আলো, মাঝে মাঝে রাতচরা পাখির অদ্ভুত ডাক
বন-বস্তি হতে ভেসে আসে মাদলের আওয়াজ, বজরায় এরা আটজন নির্বাক
তারার আলো দু-পারের জঙ্গলে; নদীতে; অপার স্নিগ্ধতায়  মায়াবী সুন্দরী
মাঝে মাঝে এপারে ওপারে অন্ধকারে ভেসে ওঠে জ্বলজ্বলে চোখ সারি সারি
নিধি জানে না কোন জানোয়ার, ফিস ফিস করে বলে, ঝড়ো ; ওগুলো কারা !
ঝড়ো খানিক ভাবে, বাকিরা চুপচাপ, ধীর উত্তর;  মনে হয় এক দল বরা ।


বুনো গন্ধ মাখা অজানা ভয়; সাথে শিহরিত ভ্রমণ বিলাসে রাত কাটে বজরায়  
পাতলা কুয়াশার চাদরে ভোরের নদী; জঙ্গলের মায়াবী ডাক, আয় ওরে আয়
কেউ ঘুমিয়ে কেউ জেগে বজরার ঘরে, জোয়ারের স্রোতের দুলুনিতে মায়াময়
ধীরে ধীরে অংশুমালী জাগে সবুজ-হলুদ মাথা ছুঁয়ে জলে চরায়; নরম ঊষ্ণতায়  
নিধি নোঙর তোলে, ঝড়ো হাল ধরে দখিনে এগিয়ে, বজরার মুখ ঘোরায় পুবে  
মিতেদের ডাক দেয় নিধি, একে একে বাইরে এসে সামনের পাটাতনে বসে চেপে    
ঝড়ো শিষ দেয়, বলে বাঁ-দিকি, নিধি সচকিত, মিতেদের ঠ্যালা দে বলে ইশারায়  
রোদমাখা হেঁতাল সারির ফাঁকে বিশাল এক জোড়া  বাঘ, চোখ আটকে যায়  
মোহময়ি রূপ সবুজ চিকন পাতার ফাঁকে, আদরের ঢঙে ঢলাঢলি, উষ্ণতা চায়
নিধি বলে এরা কি জোড়ায় থাকে ! চাপা স্বরে ঝোড় বলে; এখন পেমের সময়  
হালের চাপে বজরা প্রায় স্থির, মুখে কথা নেই কারো, বন্ধ শ্বাস;  চোখে ঘোর
সম্বিত ফেরে ঝোড়র ডাকে, ঘাড় ঘোরায় পিছে, চরে রোদ পোহাচ্ছে কয়েকটা মকর      
লম্বা ধূসর;  গাছের গুঁড়ির মত পড়ে আছে, মিতেরা একে অন্যকে খামচে ধরে
বেলা বাড়ে, ভাটায় ফিরতে হবে সন্ধ্যার আগে, ঝড়ো বজরার মুখ ঘোরায় উত্তরে।


নিধি,  দুপুরের খাবারের যোগাড়ে ব্যস্ত, বাকিরা ভিতরে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে  
বজরা এগোয় ভাটার টানে; অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় কাটছে সময়, কথা হয় ফিস-ফাসে        
বজরার ছলাৎ ছলাৎ জল ভাঙার শব্দ ছড়িয়ে পড়ে নিঝুম অরণ্যে, উদাসী নদীর বুকে      
কাদাখোঁচার ঝাঁক চরে ওড়ে, কেওড়ার নিচে সচকিত ছোট বড় হরিণ  উদাস চোখে  
জলের শব্দে সচকিত সবাই; ঘাড় ঘোরায় পিছনে, দাঁতের ফাঁদে হরিণ, ডুবছে কুমীর  
আত্মরক্ষার তাগিদে শ্বাসমূল মাথা তুলেছে, ভালো রাখতে নিভৃত অরণ্যের সবুজ শরীর  
কোথাও কুল ভেঙে ওপড়ানো গাছের মৃত শাখা জানান দেয় অস্তিত্ব, ছাল খসা পচা ডালে  
হয়ত বলতে চাইছে আরণ্যক জীবনের  বোবা ইতিহাস, যার কথা জানবে না কেউ কালে  
ঝড়োর হাঁকে নিধি দৌড়ে বজরার সামনে যায়, লগি মেরে গতি কমায়, সামনেই ডোবা চর    
ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে বাঁক নেয় অন্য শাখায়, ভাটায় শুকনো খাঁড়ি জঙ্গলের ভিতর      
নিধি হেঁকে বলে বজরা ভেড়াতে, ইশারায় দেখায় সামুদ্রিক কাঁকড়ার দল চরে  
লম্বা সঁড়াসি আর টিন হাতে নিধি লাফিয়ে নামে,  খপাখপ কয়েকটা ধরে টিনে ভরে  
নিধির নজর কাঁকড়ায়; হুঁশ নেই, ঝোড়োর হাঁকে কাটে ঘোর, বাতাসে শার্দূলের গন্ধ    
লাফিয়ে বজরায় ঊঠে লগির ঠেলা, বলে মিতেরা ভিতর যাও, রাখ কপাট বন্ধ      
হালের মোচড়ে বজরা মাঝ নদীতে, নিধি আতঙ্কের চোখে ঝোড়োর পাশে যায়  
পাটাতনে বসে,  ঘোর লাগা চোখে চেয়ে থাকে জঙ্গলে, চোখে পড়েনি দক্ষিনরায় ।  


সোনারপুর
১০/৯/২০