সোমবার,
১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ
শান্তিনিকেতন, বোলপুর।


প্রিয় ফরিদা,


আমি তোমার অনেক চেনা মানুষের ভীড়ে,
বিবর্ণ কায়ার ধূসর একটি মুখ।
নিজের ছায়ার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে,
দূর থেকে দেখতাম তোমার মৌন চলাফেরা।
ফরিদা, এই চিঠি হাতে পেয়ে তোমার চোখে যে বিস্ময়ের ঢেউ,
তার মুহুর্মুহু কাঁপন, শতশত মাইল দূর থেকেও আমি স্পষ্ট অনুভব করছি।
আমি যে এমনি, আড়াল ভেঙে আলোতে আসার সাহস-
আমার সেদিনও ছিলোনা, আজও নেই।
আমি যে ব্রাহ্মণ মাস্টার মশাইয়ের ছেলে;
হাজার বছরের শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা থেকে ভক্তি, আর ভক্তি থেকে ভয়।
সমাজের ভয়, তোমাকে পেয়ে হারানোর ভয়।


খাম ছিঁড়তেই, যে শুকনো গোলাপ পাপড়িতে তোমার চোখ আটকাবে,
তার একটা লম্বা চওড়া ইতিহাস আছে।
অতো সময় তোমার হবে কি-না, অথবা তুমি আদৌ-
এ চিঠি পড়বে কি-না এসব ভেবে সংক্ষেপেই লিখছি।
চৌদ্দশ তিন এর জ্যৈষ্ঠের শেষ দিন ছিলো সেদিন।
সারাদিন প্রচন্ড দাবদাহের পরে বিকেলে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো।
পড়ার ঘরের বারান্দায় চারটি মেলানো ছাতা মাটিতে রাখা আছে।
রোজকার মতো বাবার কাছে ইংরেজি পড়তে এসেছিলো বীথি, শ্যামলী, হাসনা আর জাহেদা।
একপাশের বেঞ্চিতে ওরা চারজন, আর উল্টোদিকের একটাতে আমি।
বইয়ের আড়ালে, মুখে একটার পর একটা বাতাসা পুরছি।
এমন সময় হাসনার মুখে প্রথম শুনি তোমার নাম, সেই সাথে গুণের ডালাও যেন উপচে পড়ছিলো।
তোমার হাঁটা, চলা, কথা বলা এমনকি কিছু না করাতেও-
একটা সুগঠিত ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেলাম ওদের হাসি ঠাট্টায়।
বিশ্বাস করো বা না করো, সেদিন থেকেই তোমাকে-
একটিবার দূর থেকে দেখার বাসনা-
আমার ভীতরে তিলতিল করে দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো।
এরপর, জানিনা কেমন করে পাঠ্য বইয়ের চেয়েও-
তুমিই আমার প্রিয় পাঠ হয়ে গেলে।
দিন-রাত, প্রতি মুহূর্তে শুধুই তুমি থাকতে আমার সমস্তটা জুড়ে।
আমি শুনেছিলাম তুমি খুব ধার্মিক আর পর্দানশীন।
নিয়ম করে নামাজ-রোযা, আর লেখাপড়াটাও চালিয়ে যাচ্ছো সুন্দর ভাবে।
যখন মসজিদ থেকে আযানের সুরেলা ধ্বনি ভেসে আসতো, আমি তড়িৎ সচকিত হয়ে যেতাম;
"এখন ফরিদার নামাজের সময়, আমাকেও কিছু একটা করতে হবে"।
কিন্তু কি করবো ভেবে না পেয়ে, মায়ের ঠাকুরের আসন থেকে পূজার ঘন্টা নিয়ে ক্রমাগত নাড়াতে শুরু করতাম।
এমনি করে কিছুদিন গেলো, বাড়ির লোকে ভাবলেন পড়তে পড়তে বুঝি আমার মাথাটাই গেছে।
সেদিন অঝোরধারায় বৃষ্টি নেমেছে, আকাশ ভেঙে কালো মেঘের দাপাদাপি।
বিকেলে দোতালার সিঁড়ি পেড়িয়ে, নিচে-
পড়ার ঘরের বারান্দায় নামতেই চোখ আটকে গেলো কারুকার্য করা রুপালী বর্ডারের কালো একটি ছাতায়।
ঘরে ঢুকতেই আচমকা একটি মেয়ে লাফিয়ে উঠে বললো,
"মাস্টার মশাই, আমি ফরিদা, সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স-এ মানবিকে পড়ছি।
আপনার কাছে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়তে চাই"।
আমি যেন অথর্ব হয়ে গেলাম ক্ষণিকের জন্য।
আদ্যপ্রান্ত কালো বোরখা আর হিজাব পরিহিতা মেয়েটির শুধু দুটি চোখ দেখা যায়;
বিশ্বাস আর গাম্ভীর্যের গভীরতা দু'চোখে অবিচল।
হঠাৎই সব নীরবতা ভেঙে দিয়ে হাসনা, শ্যামলী- ওরা খিলখিল শব্দে হেসে উঠলো।
আর সেই কারনটা বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগেনি তোমার।
প্রচন্ড লজ্জায় যেন নিজের উন্মুক্ত চোখ দুটিকে,
কচ্ছপের মতো অন্দরে লুকিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলে।


তারপর ছয়টি মাস কেটে গেলো,
এর মধ্যে আমাদের কথা হয়নি একটিবারেও।
কোনদিন সরাসরি তোমার দিকে তাকাইনি আর।
সে-কি লজ্জা, নাকি সংকোচ, তা আজও অজানা।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাটই মনে হলো
"আজ তোমাকে কিছু একটা দেবো", খুব পবিত্র কিছু, যা সর্বদা কাছে রাখা যায়।
কিছুতেই কিছু মাথায় আসছিলোনা, বরং কেবলই সব ভাবনা গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো।
বাড়ির পথ ধরে হাঁটছি আর ভাবছি।
কি মনে করে কাছেই বারোয়ারি দূর্গা মন্দিরে ঢুকে গেলাম,
পূজারী, বুড়ো সিধু কাকাকে বলে নিয়ে নিলাম মায়ের পায়ের কিছু ফুল;
মনে হলো এর থেকে পবিত্র কিছু আর হয়না।
বাড়ি এসে ফুলের পাপড়ি সমেত একটি চিঠি,
নিজের বানানো বিশেষ খামে, যত্নে রেখে দিলাম।
মনে মনে সংকল্প করলাম, যে করেই হোক, ফরিদাকে এই উপহার পৌঁছতেই হবে।
কিন্তু শুরুতেই সব ভন্ডুল হয়ে গেলো।
আমি যখন খাম গোছাতে ব্যস্ত, মা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি।
মায়ের রক্ত চক্ষু আমার সব আশা নিমিষে পুড়িয়ে ছাঁই করে দিলো।
চিঠিখানা টুকরো টুকরো হলো, কিন্তু মায়ের ফুল বলে পাপড়ি গুলি বেঁচে গেলো।
পৃথিবীর কঠিনতম দিব্যিগুলি দিয়ে, মা সেদিন আমাকে চিরদিনের মতো বধ করলেন।


পরদিন থেকে তোমাকে আর দেখতে পেলাম না, কোনদিন না।
কোথায় থাকো, কোথা থেকে আসতে কিছুই জানতামন না।
হয়তো সেও জানতে পারতাম, কিন্তু মেয়েদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে-
বাবার চরম বিধি নিষেধ ছিলো।
তিনি মনে করতেন, তাতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মনযোগ ও।চারিত্রিক স্খলন হয়।
এর দুমাস পরে বাক্স পেটরা গুছিয়ে  আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় শহরে,
বাবার চেয়ে দুই কাঠি সরেস বড় কাকার কাছে।


এরপর কোথা দিয়ে কি ভীষণ গতিতে যুগ গড়িয়ে গেছে, টের পাইনি।
শান্তিনিকেতনের কোন এক ক্যাফেতে বসে আছি একদিন।
আমার দুই টেবিল সামনে, তারুন্যে ভরপুর দুটি ছেলেমেয়ে আড্ডায় মশগুল।
আমি ওদের খুব ভালোই চিনি, ওরা আমারই ছাত্র, খুবই সম্ভাবনাময়।
তাপস আর নুসরাত। কেন জানিনা হৃদয়ের কোন অতল গহ্বর থেকে-
'ফরিদা' নামটি আমার মুখ দিয়ে আচমকা বেড়িয়ে গেলো।
হা হা হা। সত্যিই বড় অদ্ভুত এই একক প্রেম।
কি জানি কি মনে হলো, আর কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলাম।
কল্পনায় কতো কি আঁকলাম, জুড়লাম।
এই চিঠি কোনদিন তোমার কাছে পৌঁছবেনা সে আমি জানি ফরিদা।
কিন্তু তাতে কি-ই বা এসে গেলো? আমার মনের এক গোপন কোনে,
আজো তুমি বেঁচে আছো প্রিয় ছোট্ট ফরিদা।
তুমি যে আমার প্রথম ভালো লাগতে শেখা, প্রথম ভালোবাসতে শেখা।
সেসব কোনদিন না-ই বা জানলে, এই বিশাল পৃথিবীর এক কোনে-
আমৃত্যু আমার বেঁচে থাকার অব্যর্থ টনিক হয়েই থাকলে।
শুধু ঈশ্বর জানবেন, আর এই শুকনো পাপড়িরা জানবে,
আমি আজও কতোটা ভালোবাসি তোমাকে।
কতোটা অনুভব করি তোমাকে।


আমি ভালো আছি, ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে ভালো আছি।
তুমিও ভালো থেকো প্রতিদিন।
নব সূর্যের আলোক ছটায় উদ্ভাসিত হয়ো নিজ গুণে।
ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
ছোট্ট ফরিদার জন্য আমার শুভকামনা অনি:শেষ।


ইতি
রজতাভ চৌধুরী


©সুব্রত ব্রহ্ম
৩০ মে, ২০১৬ইং
ময়মনসিংহ।