মূল কবিতা - ওয়ার্সান শিরে
অনুবাদ - চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য


এমনিতে কেউ ঘর ছাড়ে না, যদি না
ঘরের দরজাটা হাঙ্গরের মুখ হয়।
গোটা শহরকে প্রাণপণে ছুটতে থাকলে
তুমিও সীমান্তে ছুটে যাবে ঠিক
প্রতিবেশীদের দ্রুত ছুটতে দেখলে
গলায় রক্ত তুলেও তুমি তো ছুটবেই।


যে ছেলেটা তোমার সঙ্গে স্কুলে যেত,
টিন ফ্যাক্টরির পিছনে আলো-আবছায়ায়
যে তোমাকে চুমু খেয়েছে
সে যখন তাঁর চেয়ে বড় এক বন্দুক তাক করে
তুমি তখন তো ঘর ছাড়বেই
না হলে, ঘরই তোমাকে তাড়িয়ে দেবে।


ঘর নিজেই তাড়া না করলে কেউ কি পালায়!
পায়ের নিচে জ্বলন্ত আগুন, তলপেটে উচ্চণ্ড ক্ষিদে,
গলায় ধারালো অস্ত্র চেপে বসার আগে
তুমি তো পালানোর কথা ভাবনি।


তারপর উদ্গত কান্না চেপে, শেষ নিঃশ্বাসে
জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে এয়ারপোর্টের টয়লেটে
ছিঁড়েছ পাসপোর্ট। নিয়েছো কখনও না ফেরার সিদ্ধান্ত।


ভেবে দেখো, ডাঙার চেয়ে সমুদ্র নিরাপদ না হলে
কেউ কি শিশুকে নিয়ে সাগরে ভাসে?
ছুটন্ত মালগাড়ির নিচে কেউ কি নিশ্চিন্তে
নিজের দু’হাত রাখে? কেউকি সখে শুধুই
খবরের কাগজ চিবিয়ে অন্ধকার ট্রাকের পেটে
বোঝাই হয়ে পালায় বহুদূর? আর সে যাত্রা তো
বেড়াতে যাওয়া নয়! সীমান্তের কাঁটাতারের
বেড়ার নিচে হামাগুড়ি দিয়ে কেউ সখে মার খায়!


রিফিউজি ক্যাম্পে ন্যাংটো করে তল্লাশি। - কে চায়?
কিংবা কারাগার? যদিও সেটা তখন
জ্বলন্ত শহরের চেয়েও নিরাপদ মনে হয়।
সেখানে রাতে তো মাত্র একজন কারারক্ষী!
এক ট্রাক বাপের বয়সীর লালসার চেয়েও ভাল।


কিংবা, ‘ওরে কালো মেয়ে, বাড়ি ফিরে যা,’
‘রিফিউজি,’ ‘জঘন্য অনুপ্রবেশকারী’,
‘আমাদের দেশকে শুষবে বলে আসছে’
‘হাত পাতা ভিখারীর দল’, নিগ্রো, ‘দুর্গন্ধ’, ‘বর্বর’
‘নিজের দেশকে ডুবিয়ে এখানে আসছে’ –
এগুলি সত্যিই নেওয়া যায় না, হজম হয় না!


কেমন লাগে এই শব্দগুলি? তাঁদের ঘৃণ্য নজর
পিঠের চামড়া বুঝি তুলে নেয়! মনে হয়,
এভাবে শরীর টুকরো করার চেয়ে
বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেও ভাল হত।


কখনও মনে হয়, দু-পায়ের ফাঁকে চোদ্দটি পুরুষের
চেয়ে তো এই শব্দগুলিও মোলায়েম, তাই না?
পাথর নুড়ি বা হাড়গোড় চিবানো বা
নিজের শিশুর দেহ টুকরো হতে দেখার চেয়ে
এই অপমানগুলিও অনেক নরম।


আমি বাড়ি ফিরতে চাই।
কিন্তু ঘর তো হাঙ্গরের মুখ।  
বাড়ি আমার বন্দুকের নল।
ঘর তোমাকে সমুদ্রের পাড়ে ঠেলে না দিলে
তোমার পা দুটোকে আরও দ্রুত ছুটতে না বললে
কাপড়জামা খুলতে না বললে
মরুভূমিতে বুকে হাটার নির্দেশ না দিলে
সাগরের ঢেউয়ে ঝাঁপাতে, ডুবে যেতে না বললে
ক্ষিদেয় পুড়তে, সমান ভুলে ভিক্ষে চাইতে না বললে
কে আর ঘর ছাড়তে চায়, বলো?


আজ তোমার বেঁচে থাকাটাই জরুরি।
কর্কশ গলায় যতক্ষণ না কেউ বলছে
যতদূরে পার পালাও,
কে আর ঘর ছাড়ে?


আমি জানি না, আমি এখন ঠিক কি?
আমি শুধু জানি, পৃথিবীর যে কোনও এলাকাই
আজ আমার ঘরের চেয়ে নিরাপদ।
ওয়ার্সান শিরে (সোমালিয়া)
(ব্রিটিশ-সোমালিয়া দম্পতির কেনিয়া-জাত কন্যা ওয়ার্সান শিরের জন্ম ১৯৮৮তে। ২০১৩ সালে ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় আফ্রিকান পোয়েট্রি প্রাইজ এর জন্য ৬৫৫ জন কবির মধ্যে থেকে তাঁকেই বেছে নিয়েছিল। আপাতত তিনি লন্ডনে বাস করছেন। ২০১১ সালে তার প্রকাশিত কবিতার বইটির নাম অদ্ভূত – ‘টিচিং মাই মাদার হাউ টু গিভ বার্থ’। বাংলা করলে দাঁড়ায়- মাকে শেখাচ্ছি সন্তান জন্মের কথা। ব্রিটেন, ইটালি, জার্মানি, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া-সহ বহু দেশে পোয়েট্রি রিভিউ, ম্যাগমা অ্যান্ড ওয়াসাফিরি-র মত ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, পর্তুগিজ, সুইডিশ, ড্যানিশ, এস্তোনিয়ান ও অন্য আর কিছু ভাষায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। স্পুক ম্যাগাজিনের কবিতা বিভাগের সম্পাদক শিরে এই বছর তাঁর পূর্নাঙ্গ কবিতা সংকলন প্রকাশ করছেন, যেখানে এই কবিতাটি স্থান পেয়েছে। ২০১৩ সালে লন্ডনে ‘ইয়ং পোয়েট লরেট’ হিসাবে বেছে নেওয়া ছয় কবির অন্যতম শিরে। ২০১৪ সালে তাকে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড-এ ‘মাননীয় আবাসিক’ এর সম্মান দেওয়া হয়। তিনি সেখানে ছয় সপ্তাহ ধরে আদিম অধিবাসীদের শিল্পকলা কেন্দ্র ‘অ্যাব-অরিজিনাল সেন্তার ফর পার্ফরমিং আর্টস’-এর সঙ্গে কাজ করেছেন।)