"চিঠিটা অনেকেই পড়বে তবে লিখেছি তোমার জন্য"


তোমার আবেগমাখা চিঠিখানা পড়ে
আজ এতদিন পরে এসে স্মৃতির পাতায় উঠিলো ভেসে
সাক্ষী করতে চাওয়া যৌবনের প্রথম প্রহরের
শরৎ সন্ধ্যার সেই আইবুড়ির কাশবন
ভুলি নাই আজো ভুলি নাই
খুলি নাই আজো খুলি নাই
তোমার প্রেমের অলংকার । তোমার প্রেমেই-
ব্যাকুল আজো আমার এই বিরহী মন।


চাওয়া ও না পাওয়ার মাঝেই জীবনের সার্থকতা
নিশ্চয়ই পড়েছো কবিগুরুর এ কথা।
কেন উপেক্ষিত হয়েছে সেদিন সেই আইবুড়ির কাশবন?
নেপথ্য পটভূমি জানলে হয়তোবা শান্ত হবে তোমার মন।


লোকে বলে -বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ।সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের আবেগ-অনুভূতিতেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখন আর কেউ রাত জেগে জেগে বাঁছাই করা শব্দের ফুলে ফুলে বাক্যের মালা গেঁথে চিঠি লিখে না। হোয়াটসঅ্যাপ,ম্যাসেন্জারের যুগে এসে হারিয়ে গিয়েছে সেই রোমান্টিকতা ! হারিয়ে গিয়েছে চিঠির আবেদন! মাঝখানে পঞ্জিকার পাতা থেকে ঝরে গেছে অনেকগুলো বছর। হয়তোবা কোনো নিরব অভিমানে নূন্যতম যোগাযোগ‌ও রক্ষা করা হয়নি দু'জনার !আজ এতদিন পরে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় সহসাই দৃষ্টিগোচর হলো তোমার পত্র খানা। সময়ের পরিক্রমায় তোমার চুলেও আজ পাক ধরেছে।তাই প্রথমে আইডি দেখে বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠলেও তোমাকে চিনতে সময় নিতে হয়েছে কিছুটা!তবে শিরোনাম দেখেই বুঝতে কষ্ট হলো না যে,পত্রখানা আমার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত এবং তুমিই আমার সেই প্রথম যৌবনের কবি।কারণ এমন কাব্যিক শিরোনামে তুমি ছাড়া আর কে'ই বা লিখতে পারে এমন পত্র?তুমি ছিলে যেন জন্মগতভাবেই কবি।সেই ছেলেবেলাতেই তোমার কাব্য প্রতিভা দিবালোকের মতোই ফুটে উঠেছিল।কিন্তু কবি না হলেও আমি কাব্যানুরাগী ছিলাম ভীষণ। আমি‌ই ছিলাম তোমার সকল কবিতার প্রথম পাঠিকা।তুমি আমায় নাম দিয়েছিলে কাব্যলক্মী । ডাকতে আমায় সে নামেই।সূর্য আর চাঁদের মতোই যেন ছিলাম তুমি -আমি দু'জনা । তোমার কাব্যিক প্রতিভার আলো আমাতেও প্রতিবিম্বিত হয়েছিল কিছুটা ।জীবনে কবিতার "ক" লেখার আগ্রহ না থাকলেও তোমার মতো করে মোটামুটিভাবে গুছিয়ে বলতে কিংবা লিখতেও পারতাম সে সুবাদেই। অকস্মাৎ তোমার পত্রের শিরোনাম দেখে ভাবাবেগে শিহরিত হলাম খুব!তোমার পত্রের শিরোনাম সহসাই আমায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল কুঁড়ি বছর আগের বয়ঃসন্ধির সন্ধিকালের পহেলা ফাগুনে।মনে পড়ে গেল যৌবনের প্রথম প্রহরের শরতের মেঘ ভাঙ্গা শেষ বিকেলের উপেক্ষিত সেই আইবুড়ির কাশবনের কথা। তুমিতো কবি। নিশ্চয়ই এ কথা বুঝবে -গল্প,কবিতা,উপন্যাসের মতো নয়,চিঠি পড়া এবং লেখার জন্য লাগে একান্ত আলাদা সময়,আলাদা মনোভাব।তাই অপেক্ষায় ছিলাম সেই একান্ত প্রহরের।সে কারণেই তোমার পত্র পাঠ এবং প্রতিউত্তর দেওয়া হয়ে উঠেনি তৎক্ষণাৎ। পরিশেষে একান্তে নিরবে-নিভৃতে বসে আমার‌'ই তরে অর্পিত , কাব্যিক ঢংগে রচিত শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত সাহিত্য মান সম্পন্ন পত্রখানা পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম।ছাইচাপা আগুন যেন আবার জ্বলে উঠলো নতুন করে। শরতের আকাশে ভেসে বেড়ানো সফেদ মেঘের মতো মনের আকাশে ভেসে উঠতে লাগলো স্মৃতিমাখা হারানো সেই দিনগুলো। কবিতার মতো করে অজান্তেই আওড়াতে লাগলাম -


কত চন্দ্রিমা রাত হাতে রেখে হাত
কাটিয়ে দিয়েছি দু'জনায়
প্রণয়ের উল্লাসে গিয়েছি ভেসে
বসে স্রোতস্বিনীর মোহনায়।


গোধূলি বেলায় বকুল তলায়
চুপিচুপি দু'জন------
ফেরারী আসামির মতো করেছি আলাপন
স্নিগ্ধ সমীরণ দুলিয়ে দিয়েছে মন
জাগিয়ে তুলেছে প্রেম-শিহরণ।


কতো রিমিঝিমি বরষাতে
ভিজেছি একসাথে
সাঁতরে গিয়েছি ঝিলের শাপলা-শালুক তুলিতে
ফেলে আসা দিনগুলো স্মৃতি হয়ে পোড়ায়
আজো তো পারিনি প্রিয় তা ভুলিতে ।


আজ এতদিন পরে চেয়েছো জানতে কেন বিমুখ করেছিলাম কাশের বনকে তাই না?অনেক আগেই যদি তা জানতে চাওয়ার বাসনা জাগ্রত হতো তোমার মনে ,তবে হয়তোবা কিছুটা ঘৃণা,রাগ-অভিমানের পাহাড় সরে যেত আমার উপর থেকে। আহ্ তোমাদের কষ্টের কথা কত সহজেই প্রকাশ করতে পারো কবি। কিন্তু আমরা? না বলতে পারা কষ্টের আগুনে 🔥🔥দগ্ধিত হ‌ই নিয়ত।


বোঝাতে পারিবোনা হায়
হারিয়ে ফেলেছি তোমায় কোন ব্যর্থতায়?
এটুকু শুধু যাই বলে,নিরব-নিশ্চল গলে
আজো প্রিয় ভুলিনি তোমায়।


ভুলি নাই তোমার ঝকঝকে শব্দে গাঁথা
পুস্প-কোমল সে চিরকুটের ভাষা
বিরহী সুরে আজি তা বাজিতেছে ধুঁকে-ধুঁকে
স্মৃতিরা বড়‌ই বেদনা বিধুর হয়ে
শেলসম আঘাত হানছে এ বুকে!


প্রথম ফাগুনে ফুটেছিল যে ফুল
মনের কানন হতে দেইনি যেতে ঝরে
হৃদয়-মন্দিরে আজো তা সাজিয়ে রেখেছি-
পুজার ফুল করে।


তুমি কবি।হয়তো তোমার কোনো এক কবিতায় ফুটে উঠবে আমার ভাঙ্গা হৃদয়ের আর্তনাদ।ভেঙ্গে গেছে আজ আমার সকল ভয়। এখন আমার আর হারানোর কিছু নেই।তাই আজ এতো মন খুলে বলা।
মনে পড়ে? হেমন্তের কোনো এক মায়াবী মিষ্টি বিকেলে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কবিতার প্রয়োজনেই আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে -আচ্ছা কাব্যলক্মী বলতে পারো বেশ্যা শব্দের পুংলিঙ্গ কী?আমি চাপা হাসি দিয়ে বলেছিলাম-বেশ্যা শব্দের পুংলিঙ্গ করেনি তোমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ! তোমাদের এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাতে আজো নারীর আবেগ-অনুভূতিগুলো নিরবে নিভৃতে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় পুরুষের ইচ্ছের আগুনে। আমার জীবন প্রদীপের সলতেটাও সে ইচ্ছাগ্নিতেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। আমার বেলাতেও সে চিরাচরিত প্রথার হয়নি ব্যতিক্রম ।


মা বুঝলেও মেয়ের আবেগ
বুঝেনি'কো হায় পিতায়,
মায়ের ইচ্ছে ভস্ম হলো তাই
পিতার ইচ্ছায় চিতায়।।


তুমি কবি।তাই কাব্যিক ঢঙ্গেই বললাম।তাই সেদিন কথা দিয়ে রাখতে পারিনি কথা। সেদিন তাইতো তোমার অপেক্ষার অশ্রু জলে ভেসে গিয়েছিল রাঙ্গা অভিসার ।


বয়ঃসন্ধির সেই দিনগুলো হয় যদি স্মরণ
এখনো হৃদয়ে হয় রক্তক্ষরণ ।


তখন সান্ত্বনার প্রলেপ মেখে দেয় কবিগুরুর সেই পংক্তিটি -
চাওয়া ও না পাওয়ার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা।


কিংবা নিজের আবেগকে সান্ত্বনার বাণীতে সমর্পিত করি শরৎ বাবুর সেই বিখ্যাত উক্তিতে-


"বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না,দূরেও সরিয়ে দেয়"


কখনো বা মনে মনে আবৃত্তি করি চিশতীর কবিতার পংক্তিগুলো।


কালের খেয়ায় ভেসে যত দিন হবে গত
অন্তর চোখেতে ততো তুমি হবে মনোহর
তাই মিলন-বাসনা বুকে চেপে অবিরত
আপন করতে গিয়েই করে দিছি পর।।


রাত্রি হয়েছে গভীর। ঘুমিয়ে গেছে পাখিরা। ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবী। হয়তোবা তুমিও চিঠিটা পড়ছো এ নির্জন নিশিতেই।এ সময়ের হক নেই'কো আর কেবল‌ই তোমার-আমার দু'জনার। কেননা-


এখন আমি সাজায়েছি অন্য কোনো ঘর
তুমিও আজ হয়ে গেছো অন্য কারো বর।


পরিশেষে একটি কথাই বলি বারেবারে
হারাতে দিবো না বলেই হারায়েছি তারে।
বাঁচিয়ে রাখতেই ভালোবাসা করে দিছি দাফন
যোজন-যোজন দূরে গিয়েই হয়েছো আরো আপন।


ক্ষমা করে দিয়ো যদি পারো নিয়ো প্রীতি
এই বলেই চিঠিখানার টেনে দিলাম ইতি ।


কাব্যলক্মী।।