এই সেই আমার গ্রাম-
যেই গ্রামে জন্মেছিলাম আমি;
ভালবাসায় মাখামাখি-
ভুলিতে পারিনা, অমূল্য দামি।


ঠাকুরমা-ঠাকুরদা, মা-বাবা,
জেঠা-জেঠি,কাকা-কাকী পিসিমা;
দাদা-দিদি, ভাই-বোন,
কাউকেই তো ভুলিতে পারি না,
সবাই আমার কাছের অতি আপন।


যাদের কাছে ছোটো থেকে বড় হওয়া,
হাত ধরে পথ চলা-
নানান ভাবে কথা বলা,
শিখেছি মনের মতন।  


বন্ধুদের হাত ধরে-
মাঠে ঘাটে ছুটে চলেছি কত,
জমি থেকে চুপি চুপি ছিম তুলেছি,
পেরেছি যে পারে যত। তারপর-
মাঠেতে আগুন জ্বেলে নুন দিয়ে
হাড়িতে সিদ্ধ করে জমির আলে বসে,
বন্ধুরা মিলে মিশে খেয়েছি আনন্দে ভেসে।


মনের স্মৃতির পাতায় আজ আছে ভরা,
কাছে নাই বন্ধুরা, ছড়ায়ে ছিটিয়ে তারা।


তালপাতা, বস্তা সাথে ছিল কঞ্চির কলম,
দোয়াত ভরা কয়লার কালি,
এ যুগের ছেলেমেয়ে জানেনা তো ঐ কথা,
তাই বারে বারে সে কথাই বলি।


বস্তায় মোড়া তালপাতা-
বগলে লয়ে ছুটিতাম স্কুলে-
এই ছিল আমাদের শিক্ষার ধরন;
যাহা মনে গেথে রবে আমরণ।
শিক্ষকদের কত লাঠিপেটা বকাঝকা,
জীবনের রাস্তাটা হলো বাঁকা।


প্রাথমিক শিক্ষা শেষে
আপনদের ছেড়ে চলিলাম হস্টেলে,
চারিধার হলো ফাঁকা, হলাম বড় একা।
হস্টেলে বসে বসে কপোল জলে ভাসে,
একা একা বসে হোথা, ভাবতাম কত কথা,
অন্তরে নাড়া দিত, গ্রামে ফেলে আসা কত ব্যথা।


সুদুর দিগন্তে ঐ বুঝি দেখা যায়,
সবুজ বনানী ঘেরা আমাদের গ্রামখানি;
বন্ধুদের ডাকাডাকি হাকাহাকি,
মনে মনে হেথা বসে যেন আমি শুনি।
যদিও কাছে নাই তারা, সে কথাটা মানি।


বুকের মাঝে মারে, ধুপধাপ কামারের হাতুড়ি;
মনে মনে ভাবিতাম, কবে ফিরে যাব বাড়ী।


ক্রমে ক্রমে বড় হলাম,
যৌবনে পাড়ি দিলাম,
চলিলাম একা একা গ্রাম ছাড়ি।


কলেজ পেরিয়ে চাকরির খোঁজে-
পাড়ি দিলাম অজানার পথে রেলে চড়ি।
যেতে হবে বহুদুরে আপনজনদের ছাড়ি।


চাকরি হলো, সংসার হলো,
               হলো ঘর বাড়ী;
অবসর শেষে ভাবি ঘরে বসে
             পশ্চাত পানে ফিরি।


শৈশবে যাঁরা ছিল কাছাকাছি,
একা একা আমাদের ছাড়ি,
ধীরে ধীরে অসীমের পানে দিল পাড়ি।
আমার মত কত বন্ধু, গ্রাম ছেড়ে চলে গেল,
ফিরিল না আর তারা কোনদিন;
কথা ছিল শোধ করবো সবে মিলে এক সাথে,
গ্রামের কাছে পাওয়া শৈশবের কতশত ঋণ।


হলো না তো কিছু করা,
বুকে সব আছে ধরা।
      গ্রাম সেই গ্রামের মতই রইলো পড়ে,
      নতুন রাস্তা ঘাট আর নবীনের ভীড়ে।
কোন দিন ভাবি নাই যাহা,
নতুনের ছোঁয়ায় হলো আজ তাহা।


রাস্তার মোড়ে মোড়ে কত দোকান,
সকাল বিকাল আড্ডাটা যা-
সাথে থাকে অবশ্যই বিস্কুট চা।


গ্রামে ফিরে গেলে অতীতের স্মৃতি-
শুধুই ভিড় করে আসে-
পাটক্ষেত, ধানক্ষেত, আখক্ষেত,
খালে বিলে জাল ফেলে মাছ ধরা,
পুকুরে সাঁতার কাটা, উল্লাসে স্নান করা,  
আমের দিনে, গাছে গাছে পাকা আম,
স্কুল থেকে ফিরে এসে-
বন্ধুরা মিলে গাছে উঠে কত খেতাম।
ক্রমে ক্রমে জীবনটা হলো ছন্দছাড়া;
সেই সুখস্মৃতি বুকের মাঝে আজ দেয় নাড়া।


আপনজনদের আদরে ভাসাতাম বুক,
অভাব অনাদর আজ চারিপাশে,
মনে আর আগের মত পাই না তো সুখ।


শৈশব কেটে ছিল-
যেই মাটি, আর যাঁদের কোলে কাঁধে বসে,
   আজ আর তাঁরা কেউ নাই,
স্মৃতির পাতায় প্রকট অতীত, চোখবুজে-
        যেন আজও তাঁদের পরশ পাই।


চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে-
           শুধু স্মৃতিসৌধ আর সমাধি;
মনের পাতায় জাগ্রত তাঁরা,
           রবে জীবনের শেষ দিন অবধি।


কত নাম জানা অজানার,
      পায়ের চিহ্ন রয়েছে এই মাটিতে মিশে;
তাঁদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, জড়া,
           দেখায়েছে মোদের চলার দিশে।


গ্রামখানি যেন এক মহা কালের ইতিহাস বই
যারা মোরা আছি বেঁচে তাহা বুঝিলাম কৈ?
যারা চলে গেছে ক্রমে ক্রমে, ধীরে ধীরে,
তাদের মত আমরাও যাব চলে বহুদূরে।
কেউ খুঁজে পাবেনা কোথাও আর কোনদিন,
বাজিবেনা হেথা আর আমাদের হৃদয়ের বীন।


কেউ যদি ফিরে আসে, গেছে যারা গ্রাম ছেড়ে,
আপনার পথ ভুলে বসে যদি বটবৃক্ষের তলে,
শুনিতে পাবেনা কি তারা ধ্বনি মর্মের গুঞ্জনে?
ঐ কারা যেন চলে যায় বটের শুস্কপাতায় ধ্বনি তুলে।


বটবৃক্ষের ডালে বসি পাতাগুল চামর দোলায়,
        বসন্তের দক্ষিনা বায় যেন বলে যা্‌য়;
জননী-জন্মভূমি আছে মিশে তোমার রক্ত ধারায়
      আছি পাশে ভালবেসে আজীবন তোমায়।


   মনে হবে কারা যেন ফিস ফিস করে বলে,
  আমরা ঘুমিয়ে আছি আজীবন জননীর কোলে।


      কত জনের শেষ স্মৃতি মিশে আছে হেথা;
বুকের মাঝে নাড়া দিয়ে যাবে কত শত স্মৃতি,  
      কত আপনজনের অকাল প্রয়ানের ব্যথা।


আজও হারানোর দুঃখ অশ্রু ঝরাবে,
                   ভাসাবে চোখের জলে;
কত স্মৃতি পড়বে মনে বার বার,
                   বসে ঐ অশ্বত্থের তলে।


শুনবে কারা যেন গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে,
             মেঠো পথ ধরে ডাইনে বায় বলে;
গোধূলিতে ফিরবে তারা, আনন্দে আত্মহারা,
           মাঠ থেকে আপন গৃহপানে দলে দলে।


মনে হবে ছুটে যাই, ধূলার ঝড় তুলে,
আপন পর ভুলে শৈশবের সাথী বন্ধুদের সনে;
হৃদয়ের অন্তস্থলে, ভাসায়ে বক্ষ- চোখের জলে-
শুনিবে সেই ধ্বনি আপন মনে।


দক্ষিন ধারে পথের তিন মাথার খাল পাড়ে-
ঐ যে কৃষ্ণচুড়ার গাছ, লাল ফুলে ফুলে ঢাকা;
বড়দার প্রথম ছেলে, রেখেছিলাম মাটির তলায় শুয়ে,
আমি, সেজকা, আর মেজদা তিনে মিলে। সেই মুখখানা
আজও দেয় নাড়া হৃদয়ের মাঝে, ছোটো ছোটো হাত
বুলায়ে মুখে বুঝি বলে মোরে কাকা, কেন দুঃখ কর বসে,
আমি আছি তোমার পাশে, জগতের শত শিশুদের সাথে মিশে।
বাড়ীর মঠ, মন্দিরের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, জীবনের এই
স্মৃতি ঘেরা জড় সৌধ একদিন বিলিন হবে কালের গতিতে,
সেদিন জীবনের মতই এরা স্মরণীয় হয়ে রবে স্মৃতি খাতায়।
আজ তাঁরা কথা কয় হৃদয়ের সাথে আপন ব্যথায়।


পড়বে কি কারো মনে? আপন চিত্ত চেতনায়,
কত আত্মার কত অবদান,আমাদের জীবন,
তাদেরই তো শৈশব, কৈশোর, যৌবন, জড়ার পদ চিহ্ন,
আছে মিশে আমাদের এই গ্রামের ধুলায়।


যাঁদের আশির্ব্বাদের পরশ পেয়েছিলাম আমার শৈশবে,
কৈশোরে, আর যৌবনে, তাঁরা আজ আর কেউ নাই,
স্মরণ করিতে চাই তাদের নামগুলো ভুলে যাওয়ার পাই বড় ভয়,
স্মৃতির পাতায় খুঁজি তাই।  


ছিল হেথা এই বাহাদুরপুর ব্রজবাসী, রুক্মিণী, যাত্রাই, বামাসুন্দরী, কামিনী সুন্দরী, চন্দ্রকুমার, রজকিনী, আয়না, ঘাগরী, রামলাল(জামাই), ঠাকুরদাস, জেঠিমা (সোনামালা), বাবা রুহিদাস, মা সোনামুক্তা, পূর্ন, নোয়া কাকীমা(মালতী), মনোরঞ্জন, দীনেশ, ফুরফুরীদি (মিনাক্ষী) রাধিকা, প্রফুল্ল, ভাই দিলু(দীলিপ), প্রবীর, জগদীশ, তারাদি, রামরূপ মল্লিক, বৈকুন্ঠ জামাই, পিসিমা, দাদা রামকান্ত, রাজ্যেশ্বর, শ্রীকান্ত, সুভাষ, নীলকান্ত, গণেশ, কৃষ্ণকান্ত, ভক্ত, চিন্তাহরণ, ব্রজেন ভক্ত, গোপাল, হীরালাল, রামলাল, উপেন ভক্ত (ছোট), হরিদাস ভক্ত, ব্যাঙা মাঝি, সুবল করাতি, মতি বাড়ৈ, জগবন্ধু হাওলাদার, পুতুল, জলধর বৈদ্য, স্ত্রী আয়না, কেশব, উপেন, লক্ষ্মী, গোপাল, যজ্ঞেশ্বর বৈদ্য, নিরাঞ্জন বাড়ৈ, যডু বাড়ৈ, কালু কির্তনীয়া, নটবর কির্তনীয়া, অমূল্য বাড়ৈ, শশি বাড়ৈ, রজনী মধু, বুদ্ধি মধু, রামধন গাইঠা, নিতাই বাড়ৈ, পাচুদা, জ্ঞানদা, পন্ডিত জামাই, ছেলে অনকুল, চটুদা, যুগলকা, মাধবদা, বেংগুলাদা, মরা বাড়ৈ, তারা শিকারী, ডাঃ কিরন কির্তনীয়া, ললিত, মনোরঞ্জন, চিত্ত, কেশব, মনীন্দ্র, হরেন, নরেন, অবনী, নিখিল, ঊর্মিলা, বলাই ব্যাপারি, সূর্য্য ভক্ত,   ঠাকুরদাস তালুকদার, রামলাল, জীতেন, প্রিয়লাল তালুকদার, জলধর বাড়ৈ, কালশশী, শ্রীদাম বাড়ৈ, পর্বত বাগচি, পূর্ন বাগচি, তুষ্টূদা, হীরালাল বাগচি, রাজু বৈরাগী, কেদারী, মাধব বৈরাগী, মান্য পুইস্তা, বালক, ফটিক পুইস্তা, অক্ষয় ঘরামি, কার্তিক, গনেশ মন্ডল, নরেন বাইন, মরা বাইন, স্বরূপ বাইন, কমলাপুর সর্ব্বেশ্বর, দিদিমা, বুড়ামা, ছোড়দি, ইন্দুভূষন, বড়মামী, ললিত বৈদ্য(এম কম) মেজমামা, মেজমামী, ডাঃ কালিকেশব, নোয়ামামী, জগদীশ, রবি, ধলামামী, সরোজ, নিতাই, চৈতন্য, গণেশ বৈদ্য, লক্ষ্মীকান্ত বেপারী, বুদ্ধি, রাসু বঙ্কিম, পূর্ণ ব্যাপারী, রতন বাগানী, মঙ্গল, ডাঃ মাতাম গাইঠা, জলধর বৈদ্য, ডাঃ কৃষ্ণকান্ত বৈদ্য পণ্ডিত পাগল, হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ, যুধিষ্ঠীর, রসিক ব্রজেন, অজিত আ্নন্দ বাডৈ, কালুদা, রাজ্যেশ্বর, সুরেন বাড়ৈ,   চৌহাদ্দি হরিপদ মন্ডল(জামাই-পিসি), হরকান্ত বৈদ্য, মান্দারী বৈদ্য, বিহারি ভক্ত, বন্ধু ঠাকুরদা, গোপাল, উপেন ভক্ত, রবি ভক্ত, ভোলা ভক্ত, রসিক সরদার, টাবিদি(শেফালী) সরদার, নারদ শীল, যোগিন্দ্র(কাকা) শীল, অটল বৈরাগী, আনিল সরদার, হরেন বৈদ্য, উপেন বৈরাগী, জ্ঞান মাঝি, নারায়ন মাঝি, সুভাস বৈদ্য, পূর্ব কলাগাছিয়া রাধেশ্যাম মণ্ডল, শিশির ভক্ত, তরুন ভক্ত, এ,মৈত্র(মৈত্র বাড়ী) আউড়াকান্দি ডাঃ পবিত্র পাঁড়ুই, হরিদাস পাঁডুই, গোপাল কটা, রবি কটা, কলাগাছিয়া বুদ্ধিমন্ত পুইস্তা, যতীশ পুইস্তা,  গোপাল দাদু(চক্রবর্তি), রবি কাকা (চক্রবর্তি), শ্রীনাথ দাস(ডাউকা) হরেন বাড়ৈ, মাখন বাড়ৈ, অটল সরকার (এম এ), কেন্দুয়া ফটিক গোসাই, বীরেন বোস, সন্তোস দত্ত, কিরণ বোস, চৌরাশি রাইচরণ মোড়ল, ডাঃ শশীকান্ত ব্যাপারী, বাজিতপুর বিনোদ গোসাই, মতি স্বামিজী, মনোরঞ্জন মন্ডল, মন্টু দত্ত, মজিদ স্যার, কাসেম স্যার, হারুন হাওলাদার,  শশিকর স্কুল(আমার শিক্ষক) অশ্বিনী কুমার হালদার, তরনী কান্ত সরকার্‌, অতুল চন্দ্র বাড়ৈ, যতীন্দ্র নাথ হালদার, লক্ষ্মী রঞ্জন বল, সুরেন্দ্রনাথ রায়, মনিমোহন সরকার, যতীন হালদার(ছোট), শান্তি রঞ্জন সরকার, নিরাঞ্জন হালদার, যোগেশ ভৌমিক, সতীশ রায়, শিশির ভৌমিক, প্রফুল্ল কুমার দাস, আরও কত শত মা-বোনের নাম যাদের পায়ের পরশে ধন্য আমার গ্রাম।
১৫ই ফাল্গুন, ১৪২৩,
ইং ২৭/০২/২০১৭,.  
সোমবার, রাত ৪টা।   ৬৮২ তাং ০২/০৩/২০১৯।