জেগে ওঠার পর রুমে ভিড় দেখে একটু চমকে উঠি। একটু সজাগ হই তারপর আরেকটু। তারপর এটা ওটা আর ভিড়টাকে অগ্রাহ্য করতে করতে নিজেকে বাইরে বেরনোর উপযুক্ত না করে চটিতে পা না গলিয়ে সম্পূর্ণ নগ্ন পোষাকে আমি কয়েক মিনিটে রাস্তায় এসে পড়ি। সকালের মৃদু রোদে আরামে হাঁটতে আরম্ভ করি। ফুটপাত আর খালি পায়ের মিলনের শব্দ শুনতে পাই। রাস্তার আরও পাঁচরকম শব্দ শুনতে খুঁজতে থাকি। ভিড় হয়ত আরামের নয় তবু একটা স্বস্তি বোধ করি, স্ব-স্বাধীনতার প্রত‍্যেকটি অংশ-প্রত‍্যংশ আষ্টেপৃষ্টে যেন জড়িয়ে ধরছে এখন। এই চরম মুক্তি থেকে আমার কোন নির্বাসন নেই। সে ইচ্ছাও করি না।


কথার শেষ নেই কোন। যাহোক যেটা বলার বলি, একবার পরীক্ষায় খারাপ ফলের কারণে আত্মহত্যা করব ঠিক করি এবং ডাঁহা ফেল করি। কিন্তু প্রথম বুঝতে পারি আমার সাহস কম নয়। দ্বিতীয়বার যে কারণে আত্মহত্যা করব ভেবেছিলাম সেটা বেশ হাস‍্যকর এবং অবশ্যই প্রেম-ব‍্যর্থপ্রেম সংক্রান্ত। বিস্তারিত থাক এখন, সে'বার এটা বুঝেছিলাম প্রেম এবং আত্মহত্যা, দুটি একসঙ্গে ঠিক যায় না। একটা বোকামি, আর যা হই না কেন ঐ দলের বাসিন্দা আমি নই। আরও বুঝতে পারি, আমার সঙ্গে শুধু সাহসের নয় জোশেরও সহবাস আছে। তবু শেষবার যে কেন আত্মহত্যার রাস্তা মাড়িয়েছিলাম সে'কথা আমি জানি না। বলব না, বলতে চাই না।


হাঁটতে থাকি। মনে হয়, দৌড়াই, কিন্তু ইচ্ছে করে না। কোথায়-বা যাব, যেখানেই যেতে চাই পোঁছে যাই বা যাব হয়ত। ডানদিকে বাগানটায় বেঞ্চটা এখন খালি। লোকজন বসত, বসে হয়ত এখনও। সেদিন দু'জন ছেলেমেয়ে বসেছিল। তার আগেরদিন একটা কুকুর বেঞ্চটার নিচে শুয়েছিল। হাঁটছি, দু'পাশে গাছেদের পাশ কাটিয়ে গাড়িরা পালাচ্ছে। ওরা কি দ্রুত ছুটতে পারে!


বিস্তৃত সময় এখন আমার চারপাশে। মা-বাবাকে কিছুই তেমন বলার ছিল না। তবু স্বীকার করতেই হবে যে আমি অপরিণত। সাতাশ বছরের প্রায় ঘটনা বিহীন উষর প্রান্তরে কোনকিছু ঠিক বুঝেই উঠতে পারেনি। দার্শনিক সমস্যা হলেও আত্মহত্যাকে বোঝার ক্ষমতা বোধহয় দর্শনের নেই। আত্মহত্যাকে বুঝতে হবে মৃত্যু দিয়েই। কিন্তু প‍্যারাডক্স এখানেও। বুঝতে কি পারছি? উত্তর নেই। নেই? কে জানে!


পরিক্রমা মোটামুটি শেষ হয়ে এসেছে। ঘরে ভিড় আরেকটু বেড়েছে। আমার ঢাকা শরীরটা এখন মেঝেতে শোয়ানো। সিলিং-এ ঝুলে থাকাকালীন মুখটার বিকৃতি এখন অনেকটা স্বাভাবিক। সুইসাইড নোট হাতে বাবা মেঝেতে এখনও বিদ্ধস্ত বেবাক বসে। মা'কে দেখতে পেলাম না, যদিও জানি সে কেমন আছে। আমার আনন্দ হচ্ছিল না, যন্ত্রণা হচ্ছিল না, দুঃখ হচ্ছিল না। শুধু ফাঁকা ফাঁকা খালি মনে হচ্ছিল। আর দেখছিলাম মৃতদেহটার সময়ের সাথে সাথে স্থান পরিবর্তন। এবার অবস্থার বদলের সময় চলে এসেছে। খুব ইচ্ছে করছিল শুনতে, 'অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জ‍গহ লে চ‍ল জহাঁ কো'ই না হো...'। ঘড়িতে তখন বেলা বারোটা