গল্পটা বলে রাখি – তাও কম করে পঞ্চান্ন বছর পার ।
কলেজের সৌরভ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মৌ মৌ করছে, ঠিক তখনই হাতে এলো ভারত সরকারের এক শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপত্র, অনেক দূরের রাজ্য মাদ্রাজে (এখন তামিলনাড়ু) তাও কিনা নীলগিরি পাহাড়ের বেশ উঁচু তলায়, উটি ও কুনুরের মধ্যবর্তী এক পাহাড় ঘেরা খোপে । ছড়ানো উদার প্রাকৃতিক মহিমা না দেখা চনমনে যুবকের  কাছে নেহাত এক স্বর্গপুরি। তবে ক’টা দিনের জন্য ।
একমাত্র দুটো ভয়ানক বর্ষার আধিপত্য ছাড়া বাকিসময় পরিবেশ, প্রকৃতি সহ জনমানব সকলের মধ্যে বিরাজ ক’রতো  অবাক করা শৈথিল্য । চমৎকার নেশাগ্রস্ত পিনাকপাণি । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অনাবাসীরা চাইতো মুক্তি ।
মুক্তির পল যখন এই বান্দার এলো, আতিশয্যে ছেড়ে আসা মন, এক সহকর্মীকে নীচের পংক্তিতে ছন্দ মিলিয়ে যা লিখেছিল সেদিন………
(সম্পাদনা ছাড়াই এই আসরের বন্ধুদের ভাগ দিলাম।)
  
লাগছে পুলক লাগছে ভালো,
আকাশ আজ কত রঙ্গীন
কাল এখানে নীলাকাশে
ভরিয়ে রঙ আবেশহীন ।
তিক্ত ছিল বনের হাওয়া
অনুতপ্ত মন,
ভাবতে বসে অধীরভাবে
উপায় কতক্ষণ ।


জীবনের যে বিপুল বাহার
কত চমৎকার…
আজ লাগে না ভাল যাহা
কাল সে পয়ার ।
ত্রস্ত পদে রাস্তা দিয়ে
হাঁটতে যখন
খুলে দিতে অনায়াসে
মনের সে বাঁধন ।
লোকে বলত - হোমসিক্‌
তোমার প্রয়োজন ;  
আমি ভাবতাম সুখের নীড়
জড়িয়ে আছে মন ।
তাইতো, ভালো লাগতো নাকো
পাহাড় সিঁড়ি ভাঙতে -
অলস ভাবে ভাবতে বসে
আর পারি না টানতে ।


দোয়েল হেথায় না দিত শিষ,
ছিল তো ক্যালিপ্টাস ;
ছিল দেদার মুক্ত হাওয়া
তবুও হা-হুতাশ ।
‘দুর্গাভবন’- তেঁতো কফি
তেঁতো মনের দীর্ঘশ্বাস
কত দিনে বিদায় নিবি
গজাবে হাড়ে দুব্বাঘাস ।


উটি, কুনুর বাস ট্যাক্সি
আধ ঘন্টার রাস্তা
মেন গেটে কোয়ার্টার পাওয়া
সে ও তো নয় সস্তা ।
লোক নেই জন নেই
নেই কোন হৈ-হট্টগোল
নেই যে সভা
নেই তো মিটিঙ
পলিটিক্সের শোরগোল ।
এ কি আবার জীবন নাকি!
ভরে আছে শূন্যতা
লোকাল লোকের বড়ই অভাব
মরালিটির পূর্ণতা ।
আকাশ হেথায় বড়ই ছোট
সীমায়িত দৃষ্টি
চারিদিকে পাহাড়, বন
শুধুই অনাসৃষ্টি ।


লোক যা আছে সবই চেনা
রোজই এক মুখ
দর্শনে যে মনোটনি
কারে বোঝাই দুখ ।
ফ্যাক্ট্রিতে যাই ফাইল ঘাঁটি
যেন একটি কল
কোয়ার্টারে ফিরে এসে
হই বড় দুর্বল ।
মাথা ব্যাথা নানা কথা
টাইপ-‘এম’-এর গুঞ্জন
আউটলুকের বড়ই অভাব
গৃহিনীদের মন।


বসতো সভা প্রিয়জনের
ঘরের সোফার কোণটিতে -
ঘুরে ফিরে একই কথা
করুণতা সরসতা -
কবে আবার ফিরবে তুমি
‘আগরপাড়া’র জোনটিতে ।


ফিরব বাড়ী সেই মহড়া
ছ-মাস আগে চলত
টিকেট কাট, ফিগার গড়
লোকেরা তাই বলত ।
চিন্তা হত ট্রেন জার্নি
কি করব হায় -
খবর দিতাম যাচ্ছি বাড়ী
কেউ বা সাথে যায় ।


মনের লাগাম ছেড়ে দিলাম
পরিবর্তন আনতে
হেরে গেলাম ফিরে এলাম
নিজেরই অজান্তে ।


এই বারেতে শেষ ঝামেলা
না হোক আমার সঙ্গী
জানি আমি এ ট্রেন যাবে
যেন বিমান জঙ্গী ।
শেষ বারেতে ভুল ক’র না
ধরবে সোজাপথ
'মুন্নিস্বরম' টেম্পলেতে
থামাবে তোমার রথ ।
মনে পড়বে কত কথা
মুন্নিশ্বরম ব্যাকুলতা
তোমার প্রিয় জনের ;
করবে তুমি মাথা নত
চাইবে আশীষ শত শত
বলবে তুমি - 'ভালো রেখো'
রইল যারা তাদের ।


মেন গেট - উটি-কুনুর মেন রাস্তায় ফ্যাক্ট্রির সদর প্রবেশপথ ।
দুর্গাভবন - মেন গেটের উল্টোদিকে ঐ সময়ের জমাটি 'কফি শপ' ।