আজ দিনটা, ২০২১ সালের ২৪ মে।
বাবু, আজ তোমার কথা খুব পড়ছে মনে।
আজ থেকে এগারো বছর আগে ঠিক এই দিনে,
তুমি আমাদের মায়াজালের সকল বাঁধন ছিন্ন করে দিয়েছিলে পাড়ি, ঐ- অচিন  দেশে।


আমাদের পাঁচ ভাই বোনের সংসারে -
তুমিই ছিলে একমাত্র অন্নদাতা।
তারও আগে, যখন ছিল যৌথ পরিবার,
তোমার ভাইবোনেরা সবাই তখন ছাত্রাবস্থায়।
তখনও, সেই একান্নবর্তি পরিবারের -
একমাত্র উপার্জনশীল সদস্য ছিলে তুমি।
মাসের শেষে, তোমার উপার্জনের সবটুকুই -
তুমি দিতে তুলে তোমার বাবার হাতে।
সেখান থেকেই মিলত, তোমার মাসোহারা।


আর আমার মা,
ছিল ঐ পরিবারের সকলের সেবায় নিয়োজিত,
বিনা পারিশ্রমিকের এক চুক্তি-বদ্ধ শ্রমিক।
যার স্বামীর উপার্জনে চলতো গোটা পরিবার -
সে- ই ছিল ঐ পরিবারে সবচেয়ে ব্রাত্য, অসহায়।
সকলের মন জুগিয়ে চলতে হতো তাকে সব সময়।
দিনের শেষে, তার প্রাপ্তি ছিল লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা।
এসব কথা, সব ছিল তোমার অজানা।


এ সব কথা মা কোনোদিন বলেনি তোমাকে-
এই ভেবে যে, সপ্তাহান্তে যে মানুষটা বাড়িতে ফেরে-কয়েকটা ঘণ্টার জন্য,একটু শান্তি পাবে বলে !
কি করে তাকে জানাবে সে এমন কথা-
যা তোমার মনকে অশান্ত করে তুলবে!
তাই কোনোদিনই তুমি জানতে পারোনি-
তার সেই অসহায় জীবনের করুন কাহিনী !


এভাবেই সংসার চলছে ,
ক্রমশ তোমার সংসার ভারী হচ্ছে,
তোমার ভাইয়েরা সবাই তখন উপার্জনশীল হচ্ছে।
ওরা তখন ভাবছে, ওদের সংসার তো নয় ভারী !
তাহলে ওরা কেন, তোমার সংসারের ভার  বহন করবে ?


তোমার বাবা, তখন ওদের ইশারাতে-
তোমাকে দিলেন ছুটি, ঐ যৌথ পরিবার থেকে।
সেদিন তুমি বেরিয়ে এলে অভিমানে,
এক কাপড়ে, শূন্য হাতে।


সেদিন বুঝিনি আমরা ,
আসলে বিধাতার আশীর্বাদ নিয়ে -
ঐ দিনটা এসেছিল, আমাদের জীবনে।
দিয়েছিল মুক্তি, বন্দিদশা থেকে আমাদের মা'কে।


এবার আমরা যৌথ থেকে অনুতে রূপান্তরিত হলাম।
আমাদের মা, তখনও কিন্তু দিয়ে চলেছে-
সেই একই রকম শ্রম- ক্লান্তিহীন ।
কিন্তু, সেখানে ফিরে পেয়েছিল সে তার আত্মসম্মান।
এভাবেই মায়ের দাসত্ব-শৃঙ্খলবেড়ির হল অবসান।

বাবু, আজকের এই দিনে আমার মন-
কেবলই স্মৃতির পথে করছে বিচরণ।
মনে হয়, যেন এই তো সেদিনের কথা-
তুমি থাকতে তোমার কর্মস্থলে,
সপ্তাহান্তে শনিবার তুমি আসতে বাড়ি।
আমাদের বাড়ি থেকে ট্রেনের শব্দ শোনা যেত।
তুমি বাড়ি ফিরতে, তখন রাত প্রায় দশ’টা।
স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতে-
তোমার লাগতো সময়, প্রায় কুড়ি মিনিট।
আমি সপ্তাহের শেষের ঐ দিনটার জন্য -
সারা- সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করে থাকতাম।
তারপর,
ট্রেনের শব্দ পেলেই কান’টা খাড়া করে,
ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
কখন কাঁটাটা কুড়ি মিনিটের ঘরে পৌঁছাবে!
আমার যেন তখন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো।
ঘড়ির কাঁটাটা’কে মনে হত,
একটা জগদ্দল পাথরের মতো ।
যেন নড়তেই পারে না।
ঐ কুড়ি’টা মিনিট আমার যেন মনে হত-
কুড়ি’টা বছর।
এরপর তোমার পায়ের শব্দ পেলেই ,
দৌড়ে ঘর থেকে বেরোতাম -
তোমার গলা উঁচিয়ে ডাক দেবার আগেই-
দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে, তোমার হাতের ব্যাগটা নিতাম ।
আর ব্যাগটা নিয়েই,
কি আছে তাতে !
হাতড়ে বেড়াতাম।
তোমার ব্যাগে খুঁজে পেতাম -
কখনো কমলা লেবু, কখনো বা মোসাম্বি, আঙুর, আপেল, বেদানা এরকম সব নানা রকমের মরশুমি ফল।
ঐ ফলের লোভেই ব্যাগের প্রতি ছিল আমার তীব্র আকর্ষণ।
তুমিও জানতে সে কথা ।
তাই সব সময়, তুমি ব্যাগে রাখতে ঐ সব ফল।
এভাবেই ছোটোবেলাতে’ই ফলের প্রতি জন্মেছিল,
আমার এক তীব্র ভালোবাসা।


বাবু জানো, আজ ফল খেতে গেলেই-
আমার মনে পড়ে যায় তোমার কথা।
এরকম কত যে  রয়েছে স্মৃতি ,
আমার স্মৃতির মণিকোঠায়।
যদি সেই স্মৃতির মালা গাঁথি -
তবে হয়ে যাবে, সহস্র এক আরব্যরজনী।


আমার তখন দশম শ্রেণী।
যখন আমরা যৌথ থেকে অনুতে এলাম।
আমি দেখেছি,
কি ভাবে আমার মা, শূন্য থেকে শুরু করে -
এক এক করে একশো করেছে।
তখনও তুমি সেই আগের মতোই -
তোমার বেতনের সবটাই -
দিতে  তুলে মায়ের হাতে।
শুধুমাত্র নিজের হাত খরচটা রেখে।
সেই পরিমিত টাকায় সংসার চালাতে-
আমাদের পাঁচ ভাই বোনের পড়াশোনার খরচ সামলাতে -
আমার মা'কে হতে হয়েছিল দশভুজা।
মায়ের নিজের বসন ভূষণ -
এসবের প্রতি কোনোদিন ছিল না কোনো আকর্ষণ।
মা বলতো, 'বসন,ভূষণ, এসবের কি প্রয়োজন?
আমার সন্তানরাই তো আমার বসন, আমার ভূষণ'।
এটাই ছিল, আমার মায়ের জীবন-দর্শন।


তুমিও ছিলে মায়েরই মতন।
তুমিও সারা জীবন নিজের জন্য ভাবোনি কোনোদিন।
সেই একান্নবর্তি পরিবারে তোমার ভাইবোন-
সকলের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে গিয়ে -
নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছিলে।
ঠিক তেমনি ভাবেই-
আমাদের জন্যও উজাড় করে দিয়েছিলে তোমার
সব-টুকু।


আজ তাই ভাবি মনে সব সময় -
এমন বাবা মা'কে পেতে, সন্তানদের অনেক পুণ্য জমা রাখতে হয়!
আর তোমাদের পুণ্যের ভাণ্ডার তো তোমরা -
এতো দ্রুত বেগে  করেছো সম্পূর্ণ  !
যে দেবলোকও তোমাদের অভাব করেছে অনুভব!
তাইতো আচম্বিতে অবেলায় নিয়ে গেল তোমাদের ইন্দ্রলোকে, পাঠিয়ে দিব্যরথ।
  
আজ স্মৃতির মালা গাঁথতে বসে ,
আমি যে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বসেছি।
এই তো সেবার, যখন তুমি এলে আমার কাছে ,
তোমার চোখ অপারেশনের জন্য ,
তখন ছিল তোমার, বলিষ্ঠ- সুঠাম চেহারা।
অথচ, তুমি  আমাকে বললে -
এটাই আমার কাছে তোমার শেষ আসা।
আর সেটাই সত্যি হলো !
আর তুমি এলে না !


আমি পরে অনেক ভেবেছি-
এমন ভাবে কি করে সেদিন তুমি বলেছিলে?
আমি একটু রেগে গিয়ে তোমাকে ধমকের সুরে -
সেদিন বলেছিলাম,
চোখের অপারেশন তো এক মামুলি ঘটনা !
তার জন্য কি, এমন করে কেউ কখনো ভাবে!
তুমি তখন বলেছিলে হেসে, 'কেউ কি চিরদিন বাঁচে !
এর পর আর আমার আসা হবে না'।


তারপর অপারেশন হলো ,
তুমি বললে, তোমার জন্য একটা লাঠি চাই।
আমি মনে মনে ভাবছি তখন -
তোমার তো লাঠিতে ভর দিয়ে চলার মতো- শারীরিক অবস্থা নয়!
তাহলে কেন তুমি লাঠি নিয়ে চলবে ?
একথা ভেবে,
লাঠি আনার জন্য আমার ছিল না তেমন কোনো আগ্রহ।
কিন্তু কয়েকদিন বাদে আবার সেই এক কথা।
আবার সেই লাঠি চাই ।
এবার আমি বললাম -
লাঠি দিয়ে এখন কি করবে তুমি ?
এখন তোমার লাঠির নেই কোনো প্রয়োজন।


এবার তুমি খুলে বললে আমায়-
তোমার লাঠির আবশ্যকতা।
তুমি বললে ,
'এখন আমি যতদিন আছি -
ঐ লাঠি থাকবে আমার সঙ্গী হয়ে।
তারপর যেদিন আমি থাকবো না আর এই ভূঁয়ে -
ঐ লাঠি হয়েই থাকব আমি তোর কাছে সব সময়ে'।


এবার আমি বুঝলাম -
কেন তুমি লাঠির জন্য হয়েছো এত ব্যাকুল!
আজ তাই, সেই লাঠি আছে আমার ঠাকুরঘরে।
ঠাকুরের আসনের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে।
আমি জানি তুমিই আছো অতন্দ্র পাহাড়ায় -
আছো আমার পাশে, আমার সকল - ভাইবোনদের পাশে দাঁড়িয়ে, লাঠি হয়ে সব সময়।