পদ-ধ্বনি শুনি অহল্যা হইল বাহির
আচম্বিতে স্বামীকে দেখি হইল বিস্মিত,
কহিল, স্বামী কি হইল তব,
বলিয়া গেলে তুমি হইবে বিলম্ব,
তোমার যাত্রা পথে আসে নাই তো বাধা,
অসুস্থ হয় নাই তো শরীর হঠাত।
অহল্যার আশঙ্কা দেখি কহে মুনিবর,
প্রিয়ে, না হইও অধীর,
ইচ্ছা না করিল আর হইতে অগ্রসর।
এ কি কথা স্বামী, সঙ্কল্প করি হইছ বাহির,
কি হইছে এমন, গন্তব্যে না পৌছিতেই ফিরি এলে ঘর।
বলিব প্রিয়ে সে কথা বলিতেই
দ্রুত ফিরি আসিলাম ঘর,
চল প্রিয়ে, চল অন্দর মহল।
বিস্ময়ে চাহিয়া থাকে স্বামীর উপর,
মনে মনে ভাবে আজি এ কি আচরণ!
বাহির হইতে ফিরি, পদ ধৌত নাহি করি,
চলিলেন তিনি অন্দর মহল।
সংসারের কত কর্ম রহিয়াছে পরি,
শঙ্কিত মনে চলিলেন পশ্চাৎ তথাপি।
শয্যায় উপবেশন করি, উত্তরীয় পাশে রাখি,
ঘটনা বলিল প্রিয়ায় রমণীয় রঙ্গ করি।
যৌবনের দাম্পত্য প্রেম, কামনার সোমরস
যেন বিলাচ্ছেন পাত্র ভরি ভরি।
বিস্মিত অহল্যা ভাবে, এ ভাব বিস্মিত কবে,
স্বামীর আজি তবে এ কি আচরণ,
স্বামী ও তাঁহার চরিত্রের মাঝে এ কি ব্যবধান!
শুনিয়া বিবরণ, ধীরে ধীরে জাগিল শিহরণ
কামনার বাঁধ ভাঙ্গি জল বহে কল কল,
একদা নদী রূপে নানা পথ অতিক্রমি
পরিল সাগর। বহুক্ষণ বহিয়া গেল,
সংসার রহিল এলো মেলো,
রসের সাগরে দোঁহে ডোবে আর ভাসে...।
হেন কালে অকস্মাৎ, দুয়ারে পরিল হাঁক,
কি গো কোথায় তুমি, সংসার এখনও অগোছালো
কি হইল আজ! পরিচিত কণ্ঠস্বর-
বজ্রের মত ছুটিল- ঘর হইতে ঘর,
অহল্যার চেতনায় ফিরিল সম্বিত।
এ কি কথা, কে তুমি দুষ্ট?
ছল করি তুমি আমায় করিছ বিভ্রান্ত!...
আমি হয়েছি পতিত।
পতিব্রতা স্ত্রী হইছে পতিত,
গৌতম মুনির পত্নী হইছে পতিত,
ইহার চেয়ে ভীষণ দুঃখ আর কি অহল্যার।
আপনার মৃত্যু যেন আপনি দেখিয়া
লুটায়ে পরি করিল আর্তনাদ।
অন্দর মহল হইতে, আর্তনাদ শুনি,
তীব্র উৎকণ্ঠায় মুনি প্রবেশিল ঘর,
একি, ঘরের ভিতর মুনি-সম অন্য পুরুষ দেখি!
বুঝিয়া উঠিতেই ছদ্মবেশী পুরুষ
মুহূর্তেই হইল পলাতক।
অহল্যা কাতর স্বরে কহিল মুনিবরে, স্বামী,
এ কি হইল আমার!
মুনি কহে- কি কহিব তোমায়
ছদ্মবেশী পুরুষেরে দেখি হইতে পারে ভ্রম,
কিন্তু তার চলন বলন,
তাতো নিশ্চয় নহে আমার মতন,
রূপ-দেহে হইতে পারে ভ্রম
ভাব-দেহে তো নয় কেহ, কাহারও মতন।
এত কাল লইয়া মোরে, করিছ তুমি ঘর
কহ প্রিয়ে, তোমার এতটুকু হয়নি সংশয়?
এ নাহি হইতে পারে।
নিশ্চয়, কামনায় আচ্ছন্ন হইয়া ছিল মন,
তাই সংশয়কে দাওনি আমল
প্রচ্ছন্ন চিত্তে করিতে পারনি বিচার।
অহল্যা নিরুপায়,
কি ভাবে করিবে সে স্বামীর চরণ সেবা,
কেমনে সম্ভাষিবে সন্তান সম শিষ্যকুলে।
ঘৃণা-লজ্জা-ভয় – যুগপৎ হইল উদয়,
না কহিতে পারে কথা, না করিতে পারে আর্তনাদ,
চেতনায় তীব্র আঘাত লাগি হইল পাষাণ......।
মুনির নানা প্রবোধ বাক্যে, অনুরোধ-উপরোধে
কিংবা তিরস্কারে, অহল্যার প্রাণে, নাহি জাগে সাড়া।
পাষাণ সহিত মুনির সংসার কাটে কোনক্রমে।
গৌতম মুনি ভাবে মনে, পরমপুরুষ বিনা
এ পাপ মোচন বুঝি প্রায় অসম্ভব।
একদা, কালের কঠিন পরীক্ষার হইল অবসান-
আসিল শুভক্ষণ,
রঘুপতি রাঘব দশরথ নন্দন
ইচ্ছা করিলেন গৌতম মুনির আশ্রম করিতে দর্শন।
সংবাদ শুনি গৌতম মুনি এগিয়ে আসেন ত্বরিত
হাঁটু গাড়ি বসি, হাত জোড় করি, করিলেন সম্ভাষণ।
ব্যস্ত হয়ে পরেন অতি, পৌঢ় মুনিবর
পথ-ঘাট করেন সূচি, করেন নিষ্কণ্টক।
মুহূর্তেই উঠিল বাজি শঙ্খ ঘন ঘন
উলুধ্বনি হইতে থাকে যেন নিরবচ্ছিন্ন।
প্রাণভরে জয়ধ্বনি করে, করি হাত জোড়
স্বর্গ যেন আসিল নামি আশ্রমের দোর।
নগ্নপদে চলেন আগে ব্রতচারী রাম
সাধ্বী-সীতা করেন স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ।
তারি পিছে চলেন ভ্রাতা রামানুজ লক্ষ্মণ
অনুসরণ করেন পাছে যত ভক্ত-জন।
মহাজনের আগমনে অজানা এক যাদু স্পর্শে
মুহূর্তেই আশ্রম প্রাঙ্গণ হইল উৎসব মুখর।
বিশাল অঙ্গন মাঝে সজ্জিত শ্বেতাসন
হরষিত মনে আসীন হইলেন রাম-সীতা যুগল।
প্রণাম করিয়া অনুজ লক্ষ্মণ দাঁড়ান দাদার পাশ
কৃতজ্ঞ হৃদয়ে মুনিবর করেন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত।
একে একে সবে ভক্ত-জন যত বার বার জানায় প্রণাম
দিয়ে কত পাদ্যঅর্ঘ্য, নতুন বস্ত্র, ফলমূল, সুগন্ধি চন্দন।
করুণার প্রেম-বারি ঝরে যেন নিরবধি-
সিক্ত হয় সবে তাতে অবগাহন করি।
প্রভুর প্রভাব, জাগায় দোলা- আশ্রমের যত ধূলি কণায়
তারি রণন- জাগায় চেতনা আশ্রম-মাতার মনো-বীণায়।
আলুথালু বেশে, বাহির হয়ে আসি
স্বপ্ন সম রূপের মাঝে অরূপেরে হেরি-
শ্রীপাদপদ্মে লুটায়ে পরি, দেয় গড়াগড়ি-
পাপের জমাট বরফ, অশ্রু হয় রাশিরাশি।
করুণা ভরা আঁখি যুগল, অশ্রু ভারে ছলছল
গন্ডবাহি ঝড়ি পরে সকলের অশ্রুজল।
সহসা দয়ালের হস্ত, করিয়া শিরে স্পর্শ,
কহিলেন- মাতা, আমরা সকলে তোমার গৃহেতে
ক্ষুধার্ত মোরা, খাওয়াইবেনা কিছু মোদেরে।
চেতনায় সম্বিত আসে- মাতৃ-মূর্তি মাতা অহল্যার।
মুহূর্তেই অবগাহন করি, শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করি
মায়ের মতন সাজান ভোগ অতি যত্ন করি।
অন্দর মহলে আনি, আপন হাতে সেবা করি
করিলেন তৃপ্ত, জীবন দেবতারে।
হৃষ্টচিত্ত পরমপিতা, মমতায় বলে- এবার মাতা
দাও আজ্ঞা, যেতে হবে বহুদূর…।
শোন মাতা, হেথায় আছে যত ভোগ-রাগ
আপন হাতেতে বিলাইও, উপস্থিত সকলের মাঝ।
মুহূর্তেই ভাঙ্গিল বাঁধ, অশ্রু বহে অবিরাম
মুহুর্মুহু করে প্রণাম, বিরহ ব্যথায়।
সজল চোখে হাত জোড় করি
রূদ্ধবাকে প্রার্থনা জানায়-
“ওগো প্রভু, তুমি মোর যথার্থ পিতা,
পিতা নাহি বুঝে সন্তানের পাপ-তাপ,
পিতার নিকট সন্তান কেবলই সন্তান।
তুমি দয়া, তুমি প্রেম, তুমি জ্ঞান, তুমি ক্ষমা
তুমি চেতনার অমৃত ধারা-
তুমি আছ অন্তরে অন্তরে….।“
এবার তবে আসিব মাতা- আজ্ঞা চাহেন প্রভু পিতা,
দুই হাতে, দুই গালে, আদর করি কহেন
ভাল থাকিও, ভাল রাখিও সবারে।
বাহির হইলেন প্রভু,-
গৌতমমুনি সহ সবে একত্রে করিল প্রণাম।
অগ্রে অগ্রে চলেন প্রভু শ্রী রামচন্দ্র
পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলেন সকল ভক্তবৃন্দ।
প্রভু-সনে চলে সব যতদূর পারা যায়
একদা দক্ষিণ হস্ত তুলি প্রভু, সকলকে জানায় বিদায়।
মুনির অনুরোধে সবে আসিল আশ্রমে
অহল্যা বিলান প্রসাদ হরষিত মনে।
আশ্রম মাতার হাতে পাইয়া প্রসাদ
আনন্দে সকলে বলে জয় সীতা-রাম।