কবি ফররুখ আহমদকে অনেকেই ‘রেঁনেসার কবি’ বা পূর্ণজাগরণের কবি বলে থাকেন। আসলে তিনি শুধুমাত্র রেঁনেসার কবি নন, তিনি একজন প্রকৃত মানবতাবাদী কবিও বটে। তিনি অনেক বড়ো মাপের কবি ছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী, তিনি যেমন বড়দের জন্য লিখেছেন তেমনি ছোটদের জন্যও কবিতা লিখেছেন। কবিতা ছাড়াও বহু কাব্য, গান, ছড়া, নাটক রচনায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে তাঁর মতো দ্বীপ্ত প্রতিভা বিরল। অত্যাচার-অবিচার, শঠতা, অন্যায় আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে কবি ছিলেন সবসময় সোচ্চার ।


এই মহান কবি  ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝআইল গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ  থেকে  ১৯৩৯ সালে আই. এ. পাস করেন।  এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্র জীবনে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েছিলেন কিন্তু চল্লিশ-এর দশকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে আমূল পরিবর্তন আসে।  


কবি ফররুখ আহমদ কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতায়। তিনি ১৯৪৩ সালে আই. জি. প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন । ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক 'মোহাম্মদী'-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন এবং বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন।


এই মানবতার কবি  যখনই মানুষের কোন দুঃখ-কষ্ট দেখতেন তখনই দারুনভাবে ব্যথিত হতেন, ১৯৪৩ সালে যখন সারা দেশে দূর্ভিক্ষ দেয়া দেয়, তখন পথের পাশে রাস্তায় অগনিত লাশ এবং ভূখা মানুষ পড়ে থাকতে দেখেন, তখনই তার কলম থেকে বেরিয়ে আসে সেই বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতাটি -  
যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেলো মোড়,
কালো পিচ ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোন দিন রাখে না সে মৃতের খবর।
জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরনীর পর
ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ির তাপে পড়ে আছে
নিসাড় নিথর।


কবি সব সময় ইসলামী রেনেসাঁর তথা ইসলামের পূণর্জাগরনের স্বপ্ন দেখতেন এবং পাঠককেও সেই স্বপ্ন দেখাতেন, তাই তিনি ইসলামের যাবতীয় চিন্তা-ধারা, বিষয়, স্বপ্ন-বাস্তবতা তাঁর কবিতায় নিগুঢ়ভাবে ফুটিয়ে তোলেন, তাঁর এই স্বপ্নের কথা বিখ্যাত  ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায় এসেছে এই ভাবে-


এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ তোরন
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠেছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠেছে দু’চোখ চেপে
তুবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ তোরন।


কবি ফররুক আহমদ এর কবিতা যেন এক শিল্প, কবিতার ছন্দ, অলংকার, শব্দ চয়ন, উপমা কৌশল পাঠককে অবাক এবং বিমোহিত করে দেয়। মহুর্তের মধ্যে পাঠক চলে যায় দূর অজানায়, তার বিখ্যাত ডাহুক কবিতায় আমার তা দেখতে পাই-


রাত্রিভর ডাহুকের ডাক...
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।


কবি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য তার কবিতায় উর্দূ, ফারসী ও আরবী শব্দ ব্যবহারে করেন, যা ছিল অনন্য অসাধারণ। তার বিখ্যাত কবিতা পাঞ্জেরী-তে সেটাই ফুটে উঠেছে-
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী ?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে
সেতার হেলাল এখনো উঠেনি জেগে ?
তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে
অসীম কুয়াশা জাগে শূণ্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী।


দারিত্রতা ছিল কবির নিত্য সঙ্গী। দারিদ্রকে কবি সাদরে গ্রহন করেছিলেন, কিন্তু ইচ্ছে করলেই তিনি বিপুল টাকা পয়সার মালিক হতে পারতেন। তিনি সমাজের অবহেলিত মানুষদের দুঃখ-কষ্টের কথা লিখে গেলেও নিজের দুঃখের কথা কাউকে তিনি বলতেন না, তাইতো কবির সাহসী উচ্চারণ-


তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের ওপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া ।


বাংলা বৈশাখ মাসকে নিয়ে অনেক কবিই কবিতা লিখেছেন, কিন্তু কবি ফররুখ আহমদের ‘বৈশাখ’ কবিতাটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা। এটি একটি অসাধারণ কবিতা। তিনি ঘুনে  ধরা সমাজের যাবতীয় ভ্রষ্টতা, মিথ্যা অহমিকা, ঝড়তা দূর করে বিজয়ী বীর, নির্ভীক সেনানীর বেশে বৈশাখকে স্বাগতম জানিয়েছেন।  


ধ্বংসের নকীব তুমি হে দূর্বার দূর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।


রোজ হাশরের দগ্ধ তপ্ত তাম্র মাঠ, বন মৃত্যুমুখী, নিস্তব্দ, নির্বাক
সূরে ইস্রাফিল কন্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এসো তুমি হে  দৃপ্ত বৈশাখ।


কবি ফররুখ আহমদ শুধু বড়দের কবি ছিলেন না, তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন তেমনি ছোটদের জন্যও লিখেছেন প্রচুর। যেমন-


মদীনার লোকজন জাগে সব প্রহরে
এলেন আখেরী নবী শোর তাই শহরে।


অন্য কবিতায়-
বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাস বনে
বকের সারি কোথায়রে
পালিয়ে গেল বাশবনে।


এই ঐতিহ্যের কবি ছিলেন তার আদর্শের উপর অবিচল ও আপোষহীন, তিনি বলতেন কাউকে খুশি করার জন্য আমি লিখিনা, আমি লিখি আল্লাহর জন্য।  


মানবাতবাদী এই কবি ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ৫৬ বছর বয়সে অনেকটা অবহেলিত  এবং  দুঃখ-কষ্টের   মধ্য দিয়ে  ইন্তেকাল করেন এবং কবি বেনজীর আহমদ এর শাহজাহানপুরস্থ বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফন করা হয়।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হল, সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), ধোলাই কাব্য (১৯৬৩), হাতেম তায়ী (১৯৬৬), নতুন লেখা (১৯৬৯) ,কাফেলা (১৯৮০), হাবিদা মরুর কাহিনী ( ১৯৮১), সিন্দাবাদ (১৯৮৩), দিলরুবা (১৯৯৪)।
শিশুতোষ গ্রন্থগুলো হচ্ছে- পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), চাঁদের আসর (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০), ফুলের জলসা (১৯৮৫)।
কবি তাঁর জীবিত অবস্থায় চারটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সেগুলো হল
  প্রেসিডেন্ট পুরস্কার- ১৯৬০,
  বাংলা একাডেমী পুরস্কার-১৯৬০,
  আদমজী পুরস্কার-১৯৬৬,
তা ছাড়া ১৯৬৬ সালে ‘পাখির বাসা’ গ্রন্থের জন্যও কবি  ইউনেস্কো পুরস্কারে ভূষিত হন।
এছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর তাকে তিনটি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। সেগুলো হল
একুশে পদক-১৯৭৭,
স্বাধীনতা পুরস্কার-১৯৮০
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার-১৯৮৪।

প্রকৃতপক্ষে কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন অত্যন্ত অসাধারণ এক প্রতিভাবান কবি। অল্প কথায় তাকে মূল্যায়ন করা অসম্বব । তাকে জানতে হলে আমাদেরকে তার প্রকাশনা সামগ্রী পড়তে হবে।