১. নদীর ধারে মা
নদীর ধারে বসে আছি, মায়ের মুখটা মনে পড়ে,
বেলা শেষে গরু ফিরে, হাটে বাজে বাঁশির সুর।
চুলের মাঝে ধুলো জমে, চোখে সারা দিনের ঘাম,
এই নদী জানে কতো কষ্ট, কতো রাতের অবসান।
ছেলেবেলায় মা ডেকে নিতো, “বাবা, আয় গো ভাত খা রে,”
শুধু সেই ডাক এখন সাথী, নদীর মতো বয়ে চলে।
তাল গাছের ছায়া পড়ে, কাঁথা সেলাই হাতে মায়ের,
আঙিনাতে ধান শুকোতো, হেসে বলতো, “বড় হবি রে!”
মায়ের ওই ঘরের জানালা, আজো দেখে চাঁদের মুখ,
পিঠার গন্ধে ভরে উঠতো, পৌষ মাসের গাভীর দুধ।
আজও যেন মায়ের কণ্ঠে, শুনি সন্ধ্যা রাগের ধ্বনি,
নদীও কাঁদে, আমি কাঁদি, চুপচাপ শুনে তিথির বাণী।
চাঁদের আলো পড়ে নদীতে, ফিসফিস করে বায়ু বই,
মায়ের কথা, শীতের রাত, কোলের ভেতর জীবন ছিল সই।
এই নদী, এই ঘরবাড়ি, সব মিশে যায় সেই মুখে,
সেই মুখটা আজো দেখি, বুকের গভীর আবেগে।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,..............................।
২. পথের বধূ
সকাল বেলা হাঁসের খ্যাঁচা হাতে,
পথে নামে বধূ গায়ে শাড়ি পাতে।
তালপাতার হাতপাখা নিয়ে,
চলে সে ধানখেতে, বৃষ্টি পায়ে।
পায়ের নূপুরে টুংটাং সুর,
পথ যেন হাসে, দেখে তার গরুর।
মাঠের চাষা তাকিয়ে রয়,
বধূর চোখে কী মায়া ছোঁয়!
শস্যের মাঝ দিয়ে সে চলে,
মাটির গন্ধে মন মুগ্ধ বলে।
চুড়ির ঝনঝন ধ্বনিতে,
রোদও থেমে যায় তার গীতেতে।
ঘরে ফেরে গোধূলি বেলায়,
কাঁধে ঝোলায় ধানের পালা,
মাঝে মাঝে থামে, জল খায়,
তার চলনে আছে বাংলার আলো।
............................................................।।
৩. পদ্মার পাড়ে প্রেম
পদ্মার পাড়ে বসে আছে দুইজন, চোখে লাজে ভরা জোনাকির আলো,
হাতে হাত, কথা কম, হৃদয়ের ভেতর জ্বলছে ভালোবাসার জ্বালা।
তরুণ তরুণী গ্রামের ছেলে-মেয়ে, কাঁঠালের পাতায় লিখেছে নাম,
স্নিগ্ধ হাওয়া, তালগাছ ঝুঁকে দেখে, চুপিচুপি হাসে অচেনা ঘ্রাণ।
সে বলে, "তুই থাকিস পাশে, নদী ভাঙলেও তোকে ছাড়ব না,"
সে হাসে, বলে, "তুই যদি থাকিস, রোদ্দুরেও আমি কাঁদব না।"
হাতের চুড়ি ঝনঝন করে, চোখের জল গোপনে শুকায়,
পদ্মা শুধু বয়ে চলে, তবু সেও প্রেমিক হয়ে যায়।
চরের গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে, যেমন তারা স্বপ্ন গাঁথে,
ভাঙা কুটিরে ভালোবাসা জ্বলে, যেখানে নেই শোভা, তবু শান্তি থাকে।
ওরা জানে, সোনার হার নাই, তবু ভালোবাসার চেয়ে দামী কিছু নাই,
পদ্মার জলে ওদের গল্প, কেবল হাওয়া বুঝে শুনতে পায়।
.....................................................................।
৪. কাঁথা সেলাই
ঘরের কোণে বসে মা, হাতে কাঁথা সেলাই করে,
প্রতিটি ফোঁড়, প্রতিটি সুতো, তার অতীত স্মৃতি জোড়ে।
এই কাঁথায় আছে তার বিয়ের দিন, শ্বশুরবাড়ির গল্প,
আছে প্রথম সন্তানের কান্না, আছে লাজে ভেজা রাত্রি।
ধীরে ধীরে ফোঁড় বসে, সুতো বদলায় রঙ,
একটি জীবন কাঁথায় গাঁথা, যেমন গেঁথেছে স্বপ্ন ঢঙ।
পাশে মেয়ে বসে জিজ্ঞাসে, "এই ফুলটা কেন লাল?"
মা হেসে বলে, "এইখানে তোর জন্মের রাতের বাল।"
সেলাইয়ের মাঝে নীরবতা, মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস,
বহু পুরনো ব্যথা মনে পড়ে, চোখের কোণে জল ভাসে।
তবু কাঁথা হয়ে ওঠে গর্ব, ভালোবাসার আলিঙ্গন,
যেখানে দুঃখ আর সুখ বোনা, একই সুতোয়, এক প্রেরণা।
........................................................................।।
৫. গরুর হাটের দিন
শনিবার হাট বসে গাঁয়ের মাঠে, গরু-ছাগলের মেলা,
মাটির গন্ধে ভরে যায় হাওয়া, বাজে বাঁশির খেলা।
চাষারা আসে দূরদূরান্ত থেকে, গরু বেঁধে গলায় রশি,
হাটের মাঝে কিশোররা ঘোরে, দেখে গরুর হাড় আর পশি।
একজন বললো, "এইটা নেবে ভাই? পাঁচহাজারে দিবো,
দেখো গা চকচকে, খায়ও ভালো, ফজরের পরেই দুধ দিও।"
হাসি ঠাট্টা, দর কষাকষি, কেউ কিনে, কেউ হাঁটে ফেরে,
আবার কেউ চায়ের দোকানে বসে, মাটির ভাঁড় হাতে ধরে।
পাশেই বাজে দোতারা সুর, কেউ গেয়ে ওঠে মেঠো গান,
হাটের মাঝে যেন বসন্ত, জেগে ওঠে প্রাণ।
শেষ বেলায় আবার সবাই ফেরে, গরু হাতে, মন ভরে,
এই হাট শুধু বেচাকেনা না, এ যে মাটির টানে ঘোর।
........................................................................
৬. আষাঢ়ের বৃষ্টি
আষাঢ় মাসে হঠাৎ একদিন, আকাশ কালো করে আসে,
ধানের খেতে নেমে পড়ে বৃষ্টি, মাটির বুকে তার হাসি।
কৃষাণ বলে, "আহা বৃষ্টি, তুই যে আমার প্রাণ,"
শুকনো জমি ভিজে উঠে, তাতে আসে নতুন গান।
পাখিরা ডাকে তালগাছ থেকে, কাকের ভয়ে হাঁস ডুব দেয়,
বাড়ির ছাদের টিনে টিনে, ঝমঝম বৃষ্টির ঢেউ বয়ে যায়।
মেয়ে বলে, "মা, ভিজি একটু?" মা হাসে, বলে, "যা রে তোরা,"
বৃষ্টিতে খেলাধুলা করে, কাদা মাখে সারা ঘোরা।
নদী ফুলে ওঠে, কূলে কূলে বাজে ঢেউয়ের সুর,
জল দেখে জেলেরা হাসে, বাঁশের জাল করে উল্টোর।
এই বৃষ্টি জীবন আনে, ফসল আনে, প্রেম আনে,
আষাঢ় মানেই রংপুরের প্রাণ, তারই মাঝে গ্রাম টানে।
.................................................................................।।
৭. তালের বড়া
পৌষ-পার্বণে বাড়িতে বসে, দিদা করে তালের বড়া,
চুলার পাশে কাহিনি বলে, কেমন ছিলো তার বিয়ে-ঘটা।
মেয়েরা ঘিরে বসে থাকে, দেখে কীভাবে বড়া হয়,
তালের রস, নারকেল, গুড়, এইতো জীবনের সৌরভ ময়।
দিদা বলেন, "এই গুড়টা আমি নিজে বানাইছি কাল,
তাল কুড়াতে গেছিলাম বেলা পাঁচটার আগে, ধান ছিলো ঢাল।"
চুলায় জ্বলে খড়ের আঁচে, বড়া ফোলে, সুবাস ছড়ায়,
মেয়েরা বলে, "দিদা, আর দিন না, এই বড়া মনটা মাতায়।"
বড়ার সাথে গল্প বোনে, ইতিহাস, কান্না, হাসির ভেলা,
গ্রামের উৎসবের এমন দিন, শহরে কেউ বোঝে না বেলা।
চুপিচুপি চোখে জল আসে, মাটির ঘ্রাণে ভরে মন,
এই বড়া শুধু খাবার না, এ যে শিকড়ের অনুরণন।
...........................................................................।
৮. মেঠো পথের ডাকে
মেঠো পথে হাঁটে গাভী, পেছনে ছোটে রাখাল ছেলে,
গলায় বাঁশির সুর বাজে, মাঠে মিশে মেঘের ঢেউ।
ধূলায় ঢাকা পথটাতে, সন্ধ্যার আলো পড়ে,
মা বলেন, "ফিরিস তাড়াতাড়ি, খেঁজুর পিঠা শোবে তোড়ে।"
পথের ধারে কচুরিপানা, খালের জলে হাসি,
বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যায়, রাখালের ছোট ভাই।
গরুর গায়ে লেপটে আছে কাদা আর শিশির,
এই পথ তার প্রিয় ছবি, প্রতিদিনের কবির।
যেখানে হাঁটেন দাদু একদিন, কাঁধে ধান ভরা বোঝা,
আজও সে পথের ধারে, গল্প জাগায় নওযোআ।
ঘাসের গন্ধ, পাখির ডাক, মাটির টানে ফিরে,
মেঠো পথের চেনা সুরে, জীবন বাঁধে ফিরে।
...........................................................................
৯. নাওয়ের গান
নদী বেয়ে যায় একখানা নাও, মাঝি গায় মৃদু গান,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলে, ফেলে আসে জীবন-ধান।
ভাটার স্রোতে টান পড়েছে, মাঝি টানে ঘাম,
তার চোখে ছায়া পড়ে, কষ্টেও আছে শান্তি-গাম।
গানের ছলে বলে সে, "ঘরে আমার চার ছেলে,
তাদের মুখটা মনে পড়ে, যখন গাই এই সুরে।"
সামনে পাটের খেত, পেছনে ফেলে চরের বালি,
জীবন তার বহমান নদী, সময় তার খেয়ালী।
মেয়েটা বলে, "বাবা, কখন আসবা আবার?"
মাঝি হাসে, "নদী জানে, কবে হবে আবার পার।"
এই গানের মাঝে কান্না মেশে, ভালোবাসা চুপচাপ,
নাওয়ের গান হয়ে থাকে, জীবনের সেরা চাপ।
...........................................................................।
১০. ধান কাটা উৎসব
ধান পাকে যখন মাঠ জুড়ে, ওঠে কুড়ি-কাঁচা গন্ধ,
কাস্তে হাতে চাষারা নামে, ফসল কেটে আনবে ধন্য।
পথে পথে গানে ভরে, মেয়েরা গায় পালা,
ছেলেরা বয়ে আনে বোঝা, পেছনে পরে খালি ঝোলা।
ধান কাটা মানে খুশির দিন, নতুন চালের ভাত,
ঘরে ঘরে খেজুর গুড়, সবার মুখে প্রীতির কথা।
ধানের গাদা উঠানে পড়ে, ছেলেমেয়েরা লাফায় তাতে,
মা বলে, "ওরে সই, দেখিস না, ধান ছড়িয়ে পড়ে পথে।"
দাদু বসে বলেন কাহিনি, আগেকার ধান কাটা,
ঘরভরা লোক, দল বেঁধে, কত গান আর হইচই হাটা।
আজও সেই ঢং ফিরে আসে, ফসলের টানে গান,
ধান কাটা মানে শুধু কাজ নয়, এ যে উৎসবের প্রাণ।
.....................................................................।
১১. গ্রামের বিয়ের দিন
শুকনো মাঠে প্যান্ডেল গাঁথা, রঙিন কাগজ উড়ছে হাওয়া,
ঢাক-ঢোলের তালে তালে, উঠোন ভরে যায় গাওয়া।
মেয়ে সাজে লাল বেনারশি, কপালে টিপ, গলায় ফুল,
পানপাতায় গুছিয়ে রাখা, সিঁদুরে আঁকা স্বপ্নকুল।
পাড়ার বুড়ো, কিশোর, কিশোরী, সবাই ব্যস্ত কাজে,
কারো হাতে পান, কারো হাতে চা, কেউ আবার গায় বাজে।
পানসালা ঘিরে হাসাহাসি, "ওরে বউ তো একেবারে রূপের রাণী!"
পেছনে দাঁড়িয়ে ছোট ভাইটি, চুপি চুপি দেখে আর টানেই টানি।
বিয়ের খাওয়া পাটে বসে, খই-মুড়ি আর মাংস-ভাত,
খোকা বলে, “আর দাও না কাকা, ওই যে মাছটা সাদা।"
মেজো ফুপাতো দাদার গান, এক ফাঁকে গেয়ে ওঠে,
"এই বিয়েতে প্রেম হোক চিরদিন, যতদিন পদ্মা বয়ে।"
শেষ রাতে বরণ হয়, মায়ের চোখে অশ্রুজল,
বউ উঠে পা রাখে পালকিতে, পেছনে থেকে যায় কলকল।
গ্রামের বিয়ে — সোনার স্মৃতি, যতই সময় যায়,
সেই বাঁশি, সেই ঢোল, আজও কানে বাজে, মাটির সুরে গায়।
..................................................................।।
১২. গোধূলির ঢেউ
গোধূলি নামে গাঁয়ের ঘাটে, শঙ্খ বাজে হালকা সুরে,
গরু ফেরে মাঠ পেরিয়ে, শিশুরা খেলে তটের ধারে।
নদীর জলে পড়ে রোদ্দুর, দোয়েলের তালে ঘুঙুর বাজে,
মা ডাকে, "আয়রে খোকা, পান্তাভাত ঠান্ডা আজে।"
চুলার পাশে দিদিমা বসে, জ্বলছে আঁচে খড়ের সাঁকো,
ঘরের মাঝে গল্প খেলে, পুরোনো সুরে বাঁশি বাজে।
গোধূলি মানে দিনশেষ গান, মাটির গন্ধে শান্তি মেশে,
শিশির পড়ে ধানের পাতায়, চুপিসারে রাত এসে।
এই সময়েই মনে পড়ে, বাবা গাইতেন কোনো গান,
বিকেলের আলোয় দুলতো মন, সুরে মিলতো প্রাণ।
গোধূলির ঢেউয়ে ভেসে যায়, সারাদিনের ক্লান্তি,
রাত নামে, চাঁদের আলোয়, গ্রামে ফেরে ভালোবাসা শান্তি।
১৩. তেঁতুল তলার গল্প
তেঁতুল গাছের নিচে বসে, পাকা ফল খায় শিশু দল,
একজন বলে, “এই তেঁতুলে, ভূত থাকতো কালরাত চল।”
বৃদ্ধা ঠাকুমা পাশে এসে, বলেন হেসে, “ভূত না ভাই,
এই গাছের ছায়ায় প্রথম দেখা হয়েছিল তোর ঠাকুরদার সঙ্গে আমায়।”
হাসি ছড়ায় গাছের তলায়, পড়ে যায় পাকা তেঁতুল,
মাটির সাথে মিশে থাকে, এক প্রজন্মের মূল।
তেঁতুল শুধু টক না ভাই, ওতে মিশে প্রেম-ভয়,
একটা গাছ, হাজার গল্প, গ্রামবাংলা সয়।
...............................................................।
১৪. কুয়োর জল
কুয়োতলা ভোরে ওঠে, কলস ভরে জল নেয় বধূ,
শাড়ির আঁচল গায়ে টেনে, দেখে পাশে ছায়া ছোট্ট ধুধু।
মা বলেন, “কুয়োর জল শুধু ঠান্ডা না, এতে আছে তোর দাদির ছোঁয়া,”
তিন পুরুষের হাতের ছাপ, এখনো থাকে কুয়ার কুয়োয়।
কলসি হাতে মেয়ে হাঁটে, বৃষ্টি পড়ে হঠাৎ হঠাৎ,
ছলকে পড়ে জল পথেতে, মনে পড়ে প্রথম পাত্রী দেখা রাত।
এই কুয়োতে শুধু জল নয়, প্রেম, দুঃখ আর হাসি,
যেন গ্রামজীবনের আয়না, শত গল্পের বাসি।
........................................................................।
১৫. আলু তুলবার দিন
পৌষের কুয়াশা ভেদ করে, মাঠে নামে সবাই,
আলু তোলে হাতে হাতে, হেসে বলে, “আরও চাই!”
শিশুরা খুঁজে খুঁজে দেখে, কোনটা বড়, কোনটা গোল,
আলুর ফাঁকে ব্যাঙ লুকায়, মেয়ে বলে, “এই যে ব্যাঙা-মোল!”
আলুর গাদা জমে ওঠে, উঠানে চলে বাছাই,
মা বলেন, “ভালো বড়ো দেখে, আগের বাজারে যা পাই।”
এই ফসল শুধু খাবার না, এতে মিশে প্রার্থনা,
মাটির নিচে পুষ্টি যেমন, তেমনি জীবনের অনুভব গাঁথা।
বধূ নয় শুধু ঘরের মানুষ,
সে তো ভূমির মা, কাজের নিখুঁত আঁকশ।
তার হাতে গড়ে সংসার,
তার হাসিতে জাগে সুখের আধার।
...................................................।।
১৬. মেয়ে যখন বউ হয়
বউ সেজে চুপচাপ বসে, মুখে নাইকো হাসি,
সিঁথির সিঁদুর রক্ত লাজে, চোখে ঢেকে গ্রাসি।
মা বলে, "মোর বুকের ধন, চললি রে পরের ঘরে,"
মেয়ে বলে, "তোমার গল্পই রাখব বুকে ধরে।"
ঘরের কোণে দিদিমা বলেন, "আমারো গেলো দিন,
এমন করেই উঠি পালকিতে, কাঁপত পায়ের তিন।"
চুপ করে বাবা দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু না বলে চায়,
তার চোখে জল, মুখে স্নেহ, বুকের ভেতর ঠাঁই।
পাড়ার ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ ফোটে ফুলের মালা,
কেউ বলে, "আমারে চিনবি তো?" কেউ হাসে খেলা খেলা।
পথের ধারে শাখ বাজে, ঢাক বাজে উঠানে,
নতুন জীবনের শুরু হয়, পুরনো গানের তানে।
পালকি চলে ধীরে ধীরে, ধানখেত পেরিয়ে যায়,
পেছনে পড়ে থাকে খোলা জানালা, বকুল গন্ধ বই যায়।
মেয়ে এখন আর শুধু মেয়ে না, সংসারের পাটি পাতা,
বউ হয়ে সে গাঁথবে গাঁথা, মায়া-মমির যাতা।
...............................................................।
১৭. চিনিকলের ধোঁয়া
পৌষের সকালে কুয়াশা ছেঁদে, চিনিকলের চিমনি থেকে উঠে ধোঁয়া,
মাঠের পাশে পিঁয়াজি গন্ধ, ঘোড়া গাড়ি করে আনা আখের রোয়া।
গাঁয়ের ছেলেরা ঘুরে বেড়ায়, চোখে আগ্রহের ঝিলিক,
ধোঁয়ার মধ্যে স্বপ্ন বাঁধে, শহরের মতো রঙিন কিছু ইট।
লাল রঙা সিগন্যাল বাজে, কাঁচা মালের হিসাব নেয়,
ফুটো টিনের ছাদে দাঁড়িয়ে শ্রমিক ভাবে, বেতন কবে দেয়?
গরম বাষ্পে জমে থাকে, চিনি নয়, জ্বালা-পোড়া জীবনের ভাব,
তবু রসের ভিতর লুকিয়ে রাখে, একটুখানি মধুর অভাব।
চিনিকলের ছাদে যে পাখি বসে, সে দেখেছে কত রাত্রি,
কেউ এসেছে, কেউ হারিয়ে গেছে, কেউ জেগেছে কৃষ্ণপক্ষের পাত্রি।
চিনি গলে, হৃদয়ও গলে, শ্রমের সুরভিতে মিশে যায়,
এই কল শুধু মেশিন নয়, গাঁয়ের স্বপ্নের পাতায় পাতায়।
...............................................................।
১৮. রাতের বাঁশি
তালগাছ পেরিয়ে আসা রাতের বাঁশি, বাজে নীচু স্বরে,
চর-পাড়ার রাখাল ছেলে, চাঁদের আলোয় গানে মরে।
শুয়ে আছে গরু-ছাগল, কাঁঠাল পাতায় ঝরছে শিশির,
একটা বাঁশি কাঁপায় বুক, দারুণ অচেনা তির।
কে বাজায়? কিসের তরে? প্রেমের না ব্যথার গল্প?
বাঁশি বলেই না কিছু, তবু জানায়, হৃদয় কোথায় মগ্ন।
বুড়ো গাছের ফাঁকে ফাঁকে, রুপালি আলো কাঁপে,
বাঁশির সুরে জাগে জীবন, তার ইতিহাস পাঁকে।
গভীর রাতে কুকুর ডাকে, চোর নাকি কল্পনার ঢল,
বাঁশির পাশে কান পেতে শোনে, মাটির গন্ধে গল।
এই সুরে যে কৃষকের ঘুম ভাঙে, সেই জানে কত রতন,
রাতের বাঁশি, গ্রামীণ জীবন—অভিমানের যত মিলন।
........................................................................
১৯. শ্মশানের ধারে
পেঁপে পাতার ছায়া পড়ে, শ্মশানের ধারে বসে সময়,
মাটি শুকায়, আগুন নিভে যায়, তবু ধোঁয়ার গন্ধ রয়।
একটা জীবনের সমাপ্তি, অন্য জীবন দণ্ডায়মান,
পাড়ার বুড়ো হেঁটে যায়, হাতে ধূপ, কপালে ঘাম।
এইখানে অনেক কান্না শুকায়, দুধের ছেলেও একদিন আসে,
পাড়ার পুকুর জানে কাহিনী, কে কখন মাটি ঢাকে।
তবু বাঁশির সুর বয়ে যায় দূরে, জীবন থামে না রে ভাই,
শ্মশান জানে, শেষ মানেই শুরু, এই মাটিতে প্রাণ রয় তাই।
কোনো ফুল পড়ে, কেউ পায়ে দেয়, কেউ মনে রাখে না বয়ে,
তবু রাতের বাতাসে শোনা যায়, কারো দীর্ঘশ্বাসের সয়ে।
শ্মশানের ধারে যে বসে কখনো, সে মানুষ হয় একেবারে গভীর,
জীবন মানে শুধু হাসি নয়, আগুনে পুড়েই যে নির্মল বীর।
..........................................................................................।
২০. নবান্নের ধ্বনি
শীতের সকালে খেতের পাশে, বাজে নবান্নের ঢাক,
পিঠার হাড়িতে বাষ্প উঠে, সুগন্ধে ভরে গাঁয়ের ফাঁক।
ধানের নতুন চাল, খেজুরের গুড়, মিশে গলে মুখে,
মেয়েরা গায়, ছেলেরা বাজায়, এক আনন্দের রুখে।
মাঠ জুড়ে সাদা ধোঁয়া, খড়ের আগুনে গরম পিঠা,
মা বলেন, “এই চাল দিয়েছি তোর বাবার প্রথম উৎসব পিঠায়।"
বুড়ো দাদু বলেন, “নবান্ন মানেই জীবন ফিরে পাওয়া,”
গাছের পাতাও যেন বলে, “তোরে দেখলে হৃদয় যায় গাওয়া।”
মাঠের মাঝে বসে গাভী, বাছুরটি দুধ টানে,
এই উৎসব শুধু খাওয়ার নয়, এতে রয়েছে কৃষকের প্রাণ।
নবান্ন মানে ধানের সুর, ঘাম দিয়ে গড়া গান,
মাটির ঘ্রাণে ঢেউ তোলে, এই আনন্দের বিস্তার জান।
...........................................................................
২১. মহুয়া কান্দে পাটের আঁধারে
বিলে নামে ধোঁয়াটে সন্ধ্যা, কুয়াশা ঝুলে বাঁশঝাড়ে,
পাটখেতের গন্ধে প’ড়ে রহস্যময় বাতাস ভারে।
মহুয়া দাঁড়ায় নদীর ধারে, চোখে বিষাদ রঙ,
হায়! প্রেমিক তার শহরে গেছে, নিয়ে গেছে জীবন ঢঙ।
মাটির কলস হাতে ধ’রে, চেয়ে থাকে দিগন্তে,
বুকের মধ্যে কথার খরা, হাসির নেই এক কণ্ঠে।
নোনাধরা কাদায় পা, ওড়নায় জড়িয়ে কান্না,
মহুয়া বলে, “আসবি না বুঝি? আমি একা এই গাঁনা।”
রাত হলে শিয়াল ডাকে, কুয়াশায় হারায় বাঁশি,
পাটের আঁধারে প্রেম ফুরায়, চোখে জমে বিষণ্ন হাসি।
তবু সে এসে দাঁড়ায় খালে, বাঁশে বেঁধে রাখে আশার ছায়া,
গ্রামের গন্ধে লেখা থাকে, মহুয়ার ভালবাসার মায়া।
.....................................................................
২২. তেঁতুল গাছের শপথ
তেঁতুল গাছটা শত বছর, খালের ধারে একা দাঁড়ায়,
কত প্রজন্ম, কত প্রেমিক, এখানে বসে স্বপ্ন গাঁয়।
লাল শাড়ি পরে যে মেয়েটি, সিঁথিতে টিপ, হাতে কাঁকন,
সে বলেছিলো, “তুই ফিরবি না, তবু আমি র’ব গগন।”
গাছটা জানে লুকানো গল্প, কান্নার রেখা পাতায় পাতায়,
দুধেভাতে থাকা দিন, আর লজ্জায় চুপ থাকা রাতায়।
পল্লীস্মৃতির গন্ধে মেশে, ঘামজল মাটির খরায়,
তেঁতুল গাছে যে শপথ রেখেছে, তারেই ধ’রে রাখে হাওয়ায়।
পাঁকাল মাছের লাফে, ভাঙা কলসের ঠুনকো ছন্দে,
সে কথা ফেরে, সে কথা কাঁদে, পল্লীপ্রেমের ছন্দে।
যে যায়, সে মুছে যায়; গাছ থাকে সাক্ষী হ’য়ে,
তেঁতুল গাছের শপথে লেখা, এক গ্রাম্য হৃদয় ছুঁয়ে।
..............................................................................।।
২৩. মাটির কান্না
শুকনো মাঠ, ভাঙা হাল, কৃষকের চেহারায় ধূসর রেখা,
আকাশ চায় বৃষ্টি ফিরাক, তবু মেঘে নেই কোনো দেখা।
মাঠ কাঁদে চুপিচুপি, ধানের চারা নিঃশব্দে মরে,
তবু কৃষক আশায় বাঁচে, “আল্লায় রহম করবো রে।”
মাটির ভাঁজে জমানো ঘাম, চোখে ক্ষুধার আগুন,
বউ বলে, “আর কতদিন, খালি পেটেই রাত পার কইন?”
কন্যা বলে, “বাবা, খাইব না, তুই খাও অন্তত,”
এই দৃশ্য দেখলে পাথরও কাঁদে, ভাঙে দুনিয়ার যুক্ত।
তবু সে চায়, বীজ বোনে, ঈদের চাঁদ দেখে আশায়,
মাটির কান্না তার হৃদয়ে বাজে, তবু হার মানে না যাই।
এতটা যন্ত্রণা, এতটা ত্যাগ, শহর তা বোঝে কই?
মাটির কান্না হল সেই গান, যা শুধুই গ্রামের রই।
......................................................।
২৪. গাভীর দুধে আঁকা সকাল
ঘুঘুর ডাকের মাঝে ভোর জাগে, গাভীর বাটে দুধ ঝরে,
বউ মাথায় কাপড় দিয়ে, দোয়াতে বসে শীতের ঘোরে।
চুলায় জ্বলে শুকনো খড়, হাঁড়িতে দুধ, পাশে ছেলেমেয়ে,
এইটুকু জীবনের আঁচড়ে, উঠে আসে বেঁচে থাকার দেয়।
চাচি বলেন, “দুধ ভাল হয়েছে, শহরে দে পাঠায়ে,”
ভাই বলে, “আজ রুটি দেব, দুধ দিয়ে চিনি মাখায়ে।”
মাটির বাড়ির খাঁজে খাঁজে, দুধের গন্ধে স্নেহ জাগে,
শীতের কুয়াশা ভেদ করে, জীবন যেন উঠেই বাঁচে।
পালকিতে নাই, নাই তাজমহল, তবু হৃদয় রত্নভরা,
এক কাপ গরম দুধেই বাজে মায়ের ভালবাসার সুরধরা।
গাভীর দুধে আঁকা এই সকাল, হল জীবনের জয়গান,
এগিয়ে চলে জীবনের গরু, গ্রামীণ প্রেমের প্রমাণ।
........................................................................
২৫. হাটের দিন
সোমবার হাট বসে, মাঠ ভরে ওঠে আওয়াজে,
কেউ কিনে গরু, কেউ হাঁস-মুরগি, কেউ খোঁজে পুরোনো সাজে।
ছোট ছেলেটা বাবার হাত ধরে, চায় বাঁশি আর খেলনা,
বউ দেখে শাড়ির ঝালর, ভাবে, “কিনবো নাকি কিছু গহনা?”
হাট মানে উৎসব, হাট মানে ধোঁয়া-মাটি-পয়সার খেলা,
মাটির হাঁড়ি থেকে শুরু করে, হেলমেটও উঠে মেলা।
বৃদ্ধ বলে, “এই হাঁসটা ভাল, ডিম দেয় টানা টানা,”
বেপারি হাসে, “তোমার জন্যই আনছি এই দানা।”
হাটের গন্ধ, মাটির টান, চালের বস্তা, রঙিন জামা,
মেয়েটি দেখে আয়নার দিকে, ভাবে, “এইটাই হইত আমার সামা।”
হাট শেষে সবাই ফেরে ঘরে, ক্লান্ত হলেও সুখে ভরে,
হাট মানেই গ্রাম্য গল্প, জীবনের পাঠশালায় সরে।