সম্মুখে তুমি আসিলে কেনই, ক্ষীণ হয়ে আসে স্বর।
দ্বিধার জমিনে কি বলিয়া আমি করিব সম্বোধন?
খেয়ালিপনার মিষ্ট ব্যথায়, অযাচিত দোলে মন।
যদ্যপি তুমি হও নাকো, মোর আত্মীয় পরিজন।
অই দুটি চোখ বিলের জলের অরুণাভ বিকিরণ।
বড় আত্মিক সেই আঁখিজোড়া যেন নিসর্গ দর্পণ।
অই মৃত্তিকারঙা মেহেদীর হাত অপরূপ কাঞ্চন।
জবান যে নির্বাক হয় মোর, ভারী লাগে সমীরণ।
বলা না বলার সংকোচে করি আত্মসংবরণ।
লাগে পিন্ডের বুকে রক্তধারার প্রবল আন্দোলন।
সেথা ছান্দিক সুর ধ্বনিত করে হৃদয় আকুঞ্চন।
যদ্যপি তুমি হও নাকো, মোর আত্মীয় পরিজন।
বাসন্তী কুহুতান তোমার অই নামের উচ্চারণ।
তুমি নকশীকাঁথার শাল পরিহিত শারদের কাশবন,
তুমি বেদনার ক্ষত লাঘবান করা হলুদের প্রলেপন,
তুমি বেলীফুলের তিতলী ঘুঙুর, বকুলের কঙ্কন।
তব কন্ঠনিনাদ সান্ধ্যবেলার ফড়িংয়ের গুঞ্জন।
যেন গোধূলিবেলার রক্তিম মৃদু আলোক বিচ্ছুরণ,
করি ঘোরবর্ষার পঙ্কিল ঘ্রাণে স্মৃতির রোমন্থন।
মোর অবচেতনার জগৎ জুড়িয়া তোমার আবর্তন,
যদ্যপি তুমি হও নাকো, মোর আত্মীয় পরিজন।
তুমিহীন লাগে বেরঙিন, ক্ষণজন্মার এ ভুবন।
তুমি মনমহুয়ার মৌসুমী বাহে শ্যামল বৃন্দাবন।
তুমি শিশিরে স্নিগ্ধ ভূমির পৃষ্ঠে শিউলি আস্তরণ।
তুমি আগরকাঠির ধূমায়িত ধূপ, মোমের দহন।
খড়কুটোঘেরা কোয়েলের নীড়, শালিকের ব্যাঞ্জন।
নিথুয়া আধার হইতে আমারে করেছো উত্তোলন।
করো মৌয়ালের ন্যায় মাধবীফুলের সুধা আহরণ,
তুমি তমসায় ঘেরা ভগ্ন হিয়ায় জাগাও সন্দীপন,
শুধু একটি নজর দেখিবার লাগি বড়ই উদ্দীপন।
যদ্যপি তুমি হও নাকো, মোর আত্মীয় পরিজন।
তুমি মরুবালিকার গোলকধাঁধা, বাতাসের নির্জন,
তুমি তপ্তদুপুরে হিমেল হাওয়া, চাতকীর নিকেতন।
তুমি প্রস্তরীভূত খন্ডশিলায় গোলাপ আচ্ছাদন।
ছোট ছোট খোপে পায়রার ঘর, চামেলীর নন্দন,
ঊর্মিল স্রোতে নদী বেয়ে চলা বজরার পাটাতন।
তুমি দূর্লভ মণি কোহিনূর, তুমি ময়ূরসিংহাসন।
তুমি স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, নবমুক্তির লাল তোরণ।
তুমি কুয়াশায় ভেজা খেজুর পাতা, পৌষের পার্বণ।
আমি দ্বিতীয়জনারে পাইনি খুঁজিয়া তোমারই মতন,
তোমায় দেখিবার মনোবাঞ্ছা আমাতে রহিয়া চিরন্তন
অকথিত শত ভাবনা আমারে করিয়াছে উচাতন।
যদ্যপি তুমি হও নাকো, মোর আত্মীয় পরিজন।
শোনো পক্ষীকূলের আলয় আশ্রয়, বিহঙ্গ প্রহরী।
শোনো অপরাহ্ণ জোনাকজ্যোতির নিভৃত পদচারী।
শোনো চঞ্চলপ্রাণ বিদ্যুষী সত্তা, স্বর্ণের কুমারী,
শোনো অবনীর মাঝে নিহিত দীপ্তি, তন্দ্রার ঘুমপরী।
বলো কি করিলে তোমারেই আমি, নিজের কহিতে পারি?
তুমি ভ্রমরের প্রিয় সুবাস মুকুল, পুষ্পের মঞ্জরি,
তুমি মন্ত্রমুগ্ধ দোয়েলের নাচ, নতুন ফুলের কুঁড়ি।
তুমি ভাটির দেশের জলতরঙ্গ, উজানে সুর লহরী।
গ্রামীণ ধাঁচের শৈলী তাঁতে, জামদানি নীল শাড়ি।
ফানুসের ন্যায় গগন রাঙানো পাটকাগজের ঘুড়ি,
ঝর্ণাধারার স্ফূর্ত প্রবাহে শ্বেত পাথর আর নুড়ি।
স্বপনে তোমার গল্প শুনায়, কাজলা চাঁদের বুড়ি।
তব দুয়ারসমীপে বার্তা আমার পৌঁছিতে কত দেরী?
বলো কি করিলে তোমারেই আমি, আপন কহিতে পারি?
বলো কি করিলে তোমারেই আমি, নিজের কহিতে পারি?