আমি অনাদি অনন্ত আবহমানকালের এক পথযাত্রী--
চলিয়াছি অযুত নিযুত লক্ষ কোটি অগণনীয় দিবারাত্রি
ধরিয়া । সংখ্যাতীত জন্ম-জন্মান্তর লোক-লোকান্তর
সাক্ষী আমার; বর্ণনাতীত চলমান এ যাত্রাপথের প্রান্তর,
নিঃসীম মহাকাশ পর্বত সমুদ্র প্রাণী ঝর্ণা ভূধর শ্যামল--
সকলেই দিয়াছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, স্নেহ নির্মল ।
ভ্রমিয়াছি আমি গ্রহ গ্রহান্তরের উজ্জ্বল মহাসমাবেশে
অবিরাম ঘূর্ণনে । ঐ চির অন্ধকার মহাশূণ্যের কেশে
গাঁথিয়া দিয়াছি নীহারিকা নক্ষত্রের হীরক-অলঙ্কার
কালের যাত্রাপথে । সেই যাত্রাপথের সঙ্গী আমার
কত যে জ্যোতিষ্কপুঞ্জ, উল্কার রাশি হইয়াছে নিঃস্ব
ফুরাইয়া আপনার শক্তি ! বিশ্বসৃষ্টির গৌরবে মহাবিশ্ব
জুড়িল আপনার যুগযুগান্তরবিস্তৃত বিচিত্র কর্মকাণ্ডে
মোরে । অবিশ্রান্ত সৃষ্টি-লয়মণ্ডিত বিপুল এ ব্রহ্মাণ্ডে
আমারও বিরাম নাই । নাই ক্লান্তি, নাই কোন অবসর
এ মহাযজ্ঞে । পড়িয়া মহাকালের গায়ে খোদিত অক্ষর,
বারম্বার আমি আপনারে ধরিয়াছি ক্ষণকাল মেলিয়া
বসুন্ধরার দৃষ্টিনন্দন বক্ষে । নিশাসমাপ্তিক্ষণে ঠেলিয়া
পূর্ব দুয়ার, অরুণোদয়ের নন্দিতবাণী দিয়াছি আনিয়া
বিহঙ্গের সুললিত কলকণ্ঠে । চিরায়ত নিয়ম মানিয়া
কুঞ্জকাননপ্রাঙ্গনশোভিত নবপ্রস্ফুটিত পুষ্পকলির
প্রাণের আহ্বান যবে হৃদয় আকুল করে মধুপ-অলির--
আমি তার মধুগুঞ্জরগান রচিয়াছি; মিশায়েছি সৌরভ
পুষ্পদলের—মত্ত দক্ষিণ সমীরণে । বাড়ায়েছি গৌরব
ঝরা পুষ্পেরও--গর্ভে তারি, ফলোন্মেষের বারতা দিয়া
পরাগের মিলনমন্ত্রে । প্রগাঢ় ইচ্ছাশক্তি দিয়াছি ভরিয়া
সুপ্ত বীজের অংকুরোদ্গমে, আপনারে করিতে প্রকাশ
কঠিন প্রাকার ভাঙে সে নীরবে । তৃষ্ণাকাতর উদাস
ধরিত্রীজনে চাক্ষুষ করায়েছি অঞ্জনঘন জলদ আভাস
নীলাম্বরে । চকিত বিদ্যুতলতা, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ক্ষিপ্র বাতাস
বসায়েছি সুছন্দে অমৃতবারির শ্রুতিসুন্দর ক্ষরণগানে
নিভৃতে বসিয়া । কত চঞ্চল নববিরহীনির অভিমানে
বাঁধিয়াছি আপনারে ! শুভ্র মেঘের অলস ভাবুক মন্থরে
বিছায়েছি স্বপনজালিকা--প্রণয়মুগ্ধ কাশের ঊর্মিশিখরে
নদীচরে, ক্ষেতের আলে । আলো-ছায়ার ক্বচিত খেলা,
শস্যক্ষেত্রের আঁধারশ্যামলিমায় চক্ষু সার্থক করিয়া মেলা
বিদায় দিয়াছি অস্তরবিরে । বৃন্তচ্যুত শেফালির কাহিনী
শুনায়েছি সিক্ত তৃণের কর্ণে ; হিমকণারে করায়েছি ঋণী
ঊষাকিরণের মণি মাণিক্য আহরণে । শীতল উত্তর বায়ু
বহিয়া আসিয়া যখন বৃক্ষশাখে প্রাচীন পত্রের ত্রস্ত আয়ু
হরণে ব্যস্ত, সেই বেদনক্ষণে নব নব কিশলয়ের বাণী
ঘোষিয়াছি বাজায়ে মুকুল-ডংকা ; অশ্রুমাখা আননখানি
মুছিয়াছি আনন্দপূর্ণ ভবিষ্য-সংকেতে । বর্ষপ্রান্তে ঋতুরাজ
খুলিয়া আপন সম্ভার, শূণ্য রিক্ত পল্লবহীন বন-অঙ্গ সাজ
সহসা ভরিয়া দেয় আনন্দসঙ্গীতে; তা আমারও চিত্ত ছায় ।
আপনারে প্রফুল্ল রাখি সেই সুরে বাজে যাহা বিশ্ববীণায় ।
আমি দেখিয়াছি, বুঝিয়াছি, জানিয়াছি সৃষ্টির রহস্য ধ্বংস
আবহমানকাল ধরিয়া । আমি আপনারে করিয়াছি অংশ
অতীতের বা তারও আগের সকল উত্থান ও পতনের--
যা মোরে দিয়াছে আনন্দ, বেদনাও বটে । আমি নিয়মের
অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা এক কর্মীমাত্র ।এমনি বারে বারে যবে                                                  
তোমাদের মাঝে আসিব ফিরিয়া-- কিছু কি ইহার মনে রবে ?