আকাশ আমার ভরলো আলোয়, আজি প্রভাতে উজ্জ্বল ;
তখনও যেমন করিত প্রাণ আলোক-বিধৌত পবিত্র, নির্মল ।
আজি যেন হেরি--চির চেনা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময় !
এমনই এক প্রাতে অদুরে ওই বনে ফুলের গন্ধে চমক
                                                লেগেছিল নিশ্চয় ।
জানার মাঝে অজানারে সন্ধান জেনো, থামেনি এখনও--
আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা- য়                                      
                     ধন্য এ ঋণ শুধিতে পারিব কি কখনও ?
আজি বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ ;
জানি নে তা আনে বয়ে ভুলে যাওয়া কোন প্রেয়সীর
                                             এলো কেশের গন্ধ ।
এই যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ আজি মধুর এ প্রাতে--
তোমার শ্বাসের শব্দ বুঝি সেই বাতাসই ছড়িয়ে রাখে
                                         এখনও তার অকৃপণ হাতে ।
তুমি যারে নিয়ত দেখেছিলে নিমেষবিহীন নত নয়নে--
তারি পানে আমিও চাই, নিয়ত নব নব সুধাসুখ চয়নে ।
ওরে মালতি, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, ওরে শালপিয়ালের বন--
কার কাছে শিখেছি বল এমনি উদাস করিতে প্রাণমন ?


এমনি করেই ওই বনের শিরে মৃদু হাওয়ায় ধীরে ধীরে
তখনও মেঘ ভেসে যেত তব সুরলোকের তীরে তীরে ।
এমনি একটি ভোরের বেলায় তুলেছো ফুল, দুলেছো দোলায় ;
আজি আমারও মন বাজিয়ে বাঁশি গান গায় ঐ বকুলের তলায় ।
আজি এতদিনে কত সূর্য্য হয়েছে অস্ত, কত বর্ষ হয়েছে গত--
যা ছিল নতুন তখন, এখনও তেমনি নতুন সেদিনেরই মত ।
আসিয়া আজি এ প্রাতে তোমারি অতি অচেনা সেই পাখি
বসিয়া শাখে গাহিল, জাগালো মোরে--নামটি আমার ডাকি’ ।
অদুরে দেখা যায় গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ বনের শেষপ্রান্তে ;
ও যে কোন বাঁকে কি ধন আছে—কোন দায়ে ঠেকে এখনও
                                                         শেখায় তা জানতে ?                                                                              
ওই রাঙামাটির পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যে গেহ--
তোমার পায়ের চিহ্ন সেথা সঞ্চিত আছে, যেথা লভিছে তা
                                                 ধরণীর অমলিন স্নেহ ।
এমনি করেই কাটবে গো দিন কাটবে, সেদিনও কেটেছে যেমন ;
এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ,
                                                আজও হেরি একই তেমন ।
হাতের কাছে কোলের কাছে যা আছে সেই অনেক আছে ;
নাহয় আমার যা হয়েছে তাই হল--তাই নিয়ে মোর হৃদয় যেন
                                                  পূর্ণসুখের নৃত্য নাচে ।
আমায় নিয়ে, সবারই সকল কথা শুনতে আমি কান পেতে রই ;
মাঝে মাঝেই ভাবি--ওদের আছে এত কথা আমার আছে কই !


যে কথায় ভরে রইল বুকের তলা, কারো কাছে হয় নি বলা--
বলার তরে বুক ফাটে মোর, তবু সেই নিয়ে হায় জীবন চলা ।
আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি--
                                             এ যে বড়োই দ্বন্দ্ব মনে ;
তাই জানি নে, চোখের জলের লাগবে আভাস নয়নকোনে
                                           কোন রজনীর শেষ ক্ষণে ।
এই জীবনে অনেক বেলায়, জাঁতাকলে কাজের ঠেলায়
                                                       ভাবি বারে বারে
ও বন্ধু, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে--।
তোমারি মতো চারিদিকে দেখি চাহি হৃদয় প্রসারি,
                                              ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি ;
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে--বুঝি, জানি, তার অমৃতস্বাদ জানি ।
এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি--বলে উদাস হয়ে যাই ;
জীবন তখন বলে বুঝি, কূল মিলেছে--আমি তো আর নাই ।
যখন একূল যাবো ছাড়ি, পারের খেয়ায় দেব পাড়ি—
                                                      ভেবেই করি ভয় ;
তখনই শুনি দ্বন্দ্ব-জয়ের বাণী--কেন রে এই দুয়ারটুকু
                                                      পার হতে সংশয় ?
আজ আমারে দিই তোমার হাতে নূতন করে নূতন পাতে--
আমার সকল অনুভূতির সীমানাতে দেখা তোমার, আমার সাথে ।
বারে বারে এই জীবনের ক্ষণে ক্ষণে তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত
সব বেদনায় বুলিয়ে যাবো সুরের তুলি--যেথায় বেসুর বাজে নিত্য ।


(ঋণ স্বীকার :- গীতবিতান )
০৬.০৫.২০২০