বৃষ্টি, তুমি কি তেমনই আছো ?


                   সেই যেমন ছিলে আমার ছোটবেলায় ।
যখন প্রায় সারাটি দিনই কাটাতুম খেলায় আর খেলায় ।
জ্যেঠা বলতো--টো টো কোম্পানি । একদম হাড় হা-ভাতে ।
ইস্কুলে তখন চাষের ছুটি--পড়াশোনার পাট কেবল রাতে ।
                               ঝরতে তুমি সকাল থেকে দুপুর ;
ফোগলা মুখে ঠাকমা কাটতো ছড়া--বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর----
অমনি দিদি উঠতো বলে--নদে এলো বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে--
                                 তিন কন্যে দান ।
তারপরেতেই আমার হাতে হ্যাঁচকা দিত টান ।
ছুট ছুট ছুট রূপনারাণের তীরে--বুকে তার লক্ষ ঢেউয়ের খেলা ;
ঝাপসা তখন--যায় না দেখা ওপারেতে হাওড়া নামের অন্য জেলা ।
                     বাঁধা ডিঙি ঝাঁকড়া বটের মূলে
ব্যতিব্যস্ত হচ্ছে তখন খ্যাপা হাওয়ায় ভীষন দুলে ।
                                                               ছলাৎছলে ঢেউগুলো
ঘাটের সনে কইছে কথা--পা বিছিয়ে দু’-সই যেন গল্পে মেতে জগত-ভুলো ।
শরীর জামা ভিজে জবজব-- ধ্যুৎ, ছোটদের আবার মাথায় ছাতা !
ফেরার সময় ধরেছি মাথায়--কি বলো তো ? মানকচুর এক পাতা ।
বাবা কিছু বলার আগেই বকতো দাদু ঘরের ভিতর থেকে ।
ঠাকমা তখন ইশারাতে দুজনকেই আড়ালে নিত ডেকে ।
আঁচল দিয়ে মুছিয়ে গা--সর্ষের তেল লাগিয়ে দিত আঙ্গুল দিয়ে নাকে ।
বাব্বা, সে কি ঝাঁঝ ! ঠাণ্ডা লাগা তখন লুকাতো কোন ফাঁকে ।
ছোটকা দেখি আনলো ধরে বঁড়শি গেঁথে বিশাল একটি শোল !
দেখে ব্যাটার লম্ফঝম্ফ পালালো ছুটে ঘরের হুলো--হাসিঠাট্টা শোরগোল ।


একদিন দেখি, দুপুরবেলায় ঝরছো তুমি অবিরাম মুষলধারে ;
ছুটে গেলেম দুদ্দাড়িয়ে চিলেকোঠার ছাদের বা’রে।
                                       ওমা, কি দেখলেম জানো ?
ভিজে ভিজে গাইতেছে মা হাত পা নেড়ে নেচে--
                            তোমরা সবাই মানো বা নাই মানো,
                     রবিঠাকুরের গান --ঝর ঝর বরিষে বারিধারা---
আমার মুখচোরা সেই মা, রান্নাঘরের আলো-আঁধারির মা--
                     বৃষ্টি তারে করেছে বাউল, করেছে আপনহারা !
গাছকোমরে ডুরে শাড়ি, ছড়ানো এলোচুলে --
পড়ছে খসে জলের ফোঁটা, টপ টপ টপ নাকের ফুলে ।
আমার মা-টি যেন পাহাড়-খাঁজে বয়ে চলা নবঝর্ণার জল---
লেফে লেফে ডিঙোয় পাথর--বড় প্রাণবন্ত, বড়ই চঞ্চল ।
কোথায় পেল কে জানে, কদম দুটি হাতের মুঠোয় ধরা---
তাই বুঝি মা বেড়া ভেঙ্গে এমন মুখরা ।
চুপি চুপি ছুটে গিয়ে দিদিকে গিয়ে ডাকি;
দিদিরও চোখ ছিটকে বেরোয়--ওই খুকিটি মা নাকি !


সে ঘরে আজ থাকে না কেউ, সাপ বাদুড়ের বাসা;
খিড়কি উঠোন সবই এখন গাছ-আগাছায় ঠাসা ।
                     মানুষগুলো এদিক ওদিক, বটগাছটি নদীর গ্রাসে ।
সুন্দর সেই স্মৃতিগুলো হারাবো কি চিরতরে ? মন কাঁপে তাই ত্রাসে ।
সন্ধ্যেবেলায় ঝিঁঝি ব্যাঙের একঘেঁয়ে সেই ডাক, জোনাকির দল ঝোপে--
সিঁধোলো সব মণিকোঠায়; হায়, সময়ের প্রখর কোপে ।
কেন সেই স্মৃতিগুলো সব সুন্দর, বড়ই মনোহরণ ?
সে সময়টাই ছিল ভালো । তাই কি ? হয়তো বা তা নয়--
                 বুঝি অন্য ছিল আমার দেখার ধরন ।
পাল্টে তো গেছে সবই, আমার দৃষ্টিটাও বটে ।
তাই রেখেছি প্রশ্নটি এ তোমার নিকটে----


বৃষ্টি, তুমি কি তেমনই আছো ?