শহরের মানুষগুলো
এখন আর খবর খুঁজে না,
খবরই তাদের খুঁজে ফেরে
এইতো সেদিন -
‘বেওয়ারিশ’ এক লাশ খুঁজছে তার আপনজনদের।


হিমঘরে শুয়ে আছে লাশটি,
সারা শরীরে তুলোর মতো বরফ জমে আছে,
মাঝে মাঝে কিছু বরফ লাল আর কালো হয়ে গেছে লাল কালো রক্তে,
রক্ত ঝরেছিলো বুক বরাবর তিনটি গর্ত দিয়ে,
আর মুখ এবং মাথা দিয়েও,
একেবারে কাছ থেকে
তিনটি গুলি ঢুকেছিলো তার বুক বরাবর,
মুখে আর মাথায় কয়টা বুঝা যাচ্ছে না,
মগজ বেরিয়ে চেহারাটাও বুঝা যাচ্ছে না,
বন্দুক যুদ্ধ - খেলায় নাকি সে মারা গেছে।


বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার আগে সে শুধু বলেছিলো,
“জনাব,
আমার বিধবা মা’
আমাকে খুঁজে না পেলে পাগল হয়ে যাবে,
ছোট বোন’টির অনেক অনেক মন খারাপ হবে’
আপনারা ভুল মানুষ’কে ধরেছেন,
একই নামের অনেক মানুষ আছে এই দুনিয়ায়।


জনাব,
আমি কখনও কোনো দাবী নিয়ে রাস্তায় স্লোগান দেয়নি,
অন্যায় দেখেও কখনো মুখ খুলিনি,
আমি কখনো রাজনীতি নিয়ে কথা বলিনি,
শুধু  বেঁচে থাকার চেতনাই আমার মূলনীতি ,
রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করিনি কখনোই,
সারাদিন পর বেঁচে থেকে মা-বোনের কাছে বাসায় ফিরলেই আমরা খুশি,
বাবা মারা যাবার পর আমাদের দরিদ্র মা’ আমাদের শুধু একটা চেতনাই শিখিয়েছে,
প্রয়োজনে চোখ, মুখ, বুক বন্ধ থাকবে,
যে কোনো ভাবে বেঁচে থাকাই আমাদের
মুল চেতনা, একমাত্র চেতনা।


জনাব,
শুধু নামের মিলের কারনে আপনারা আমাকে বন্দুক যুদ্ধের খেলোয়ার বলছেন,
আমি কখনো বন্দুকই দেখিনি,
না ভুল বলেছি স্যার ,
ক্ষমা করে দিবেন,
আপনাদের কাছে দেখিছি,
আর সিনেমায় দেখেছি,
ছোট বেলায় বাবা’কে একবার ‘খেলনা বন্দুক’ কিনে দিতে বলেছিলাম,
টাকার অভাবে তখন কিনে দিতে পারেনি আমার কেরানী বাবা,
শুধু এই অক্ষমতার জন্য আমার বাবা
অনেকদিন আমার চোখে, চোখ রাখতো না,
তাই আমার বন্দুক যুদ্ধ খেলা শিখা হয়নি,


জনাব,
আমার বাবা- মা জানলে কখনো আমার নাম ‘খোকা’ রাখতেন না,
কোনো ‘বাবা-মা’ই আর কোনোদিন সন্তানের নাম ‘খোকা’ রাখবে না।


জনাব,
আমি এই খেলার নিয়ম জানি না,
খেলার আগে আমাকে দয়া করে একবার নিয়মগুলো শিখিয়ে দিবেন,
আমার ভুল হলে
আপনারাই ঝামেলায় পরে যাবেন,
শুধু দয়া করে মুখে গুলি করবে না,
চেহারা না চিনতে না পারলে মা আমাকে সনাক্ত করবে কি ভাবে,
ডান হাতের কব্জিতে বাঁধা এই তাবিজ’টা যেনো না খুলো পরে,
আমার মা’ এই তাবিজটা আমাকে পড়িয়েছিলেন এক মাওলানা সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে
প্রভু যেনো আমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন।


জনাব,
তাবিজটা যেনো দয়া করে হাতেই থাকে,
এইটুকু দয়া আপনারা আমাকে করবেন,
আমি মরে গিয়েও আপনাদের জন্য দোয়া করবো,
আপনারা যেনো এই খেলায় আরো নাম করতে পারেন ,
জনাব, বলেন ‘আমিন’
তাহলে দোয়া কবুল হবে”।


হিমঘরে অনেকেই তাদের হারিয়ে যাওয়া আপনজন’কে খুঁজছে,
অবহেলায়, অনাদরে বেওয়ারিশ লাশগুলো
তীব্র অপেক্ষায় আছে আপনজনদের জন্য,
এক একজনের মুখের চাদর সরাচ্ছে,
কেউ কেউ অমানুষিক চিৎকার করে বেওয়ারিশ লাশের বুকে পরে যাচ্ছে,
আবার কেউ কেউ অনেকক্ষন ধরে আটকানো নিশ্বাস ছাড়ছে স্বস্তিতে।


একজন মা’ বলে উঠলো
এটা আমার ‘খোকা’র লাশ হতে পারে না,
আমার ‘খোকা’র গায়ের রং অনেক সুন্দর।
হঠাৎ সাথে থাকা সাহসী ছোট মেয়েটি কেঁদে বলে উঠলো,
“মা’ এইডাই আমার ভাই,
ডাইন হাতের তাবিজটা এখনো আছে।”


মা,
অনেকক্ষন তাবিজটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ,
যেনো অপরিচিত লাগে ‘তাবিজ’টা,
তারপর বলে উঠলো’
“চল ‘খোকা’ বাড়ীতে চল,
শরীরটা অনেক ময়লা হয়ে আছে,
গরম পানি দিয়ে গোসল করাবো তোকে”
ছোট মেয়েটি কেঁদে কেঁদে বললো,
“আমার ভাইতো মরে গেছে ‘মা’
কেনো মরলো?”


মা শুধু তীব্র হাহাকার নিয়ে চিৎকার করে বললো
“ বাবা’রে আমাকে মাফ করে দিস,
আমি কেনো যে তোর নাম ‘খোকা’ রেখেছিলাম?”
________________
রশিদ হারুন
১৩/০৭।২০১৮