আমাদের দক্ষিনের জানালা খুলতেই
একটা শীতল হাওয়া চোখে মুখে ছুঁয়ে যায়,
জানালার পাশঘেঁষা আম গাছটায় একটা কাক বসে ঝিমোচ্ছিল তখন,
আমার চোখে চোখ পড়তেই কাকটা আকাশে উড়ে গেল।
কাকের ডানার ঝাঁপটায় দুটি শুকনো আম পাতা
উড়তে উড়তে এসে পড়ল ঘরের উল্টোদিকেই
রাস্তায় চায়ের দোকানের সামনের মাটিতে।


শুকনো আম পাতা দুটি স্পষ্ট দেখার আশায় জানলা দিয়ে রাস্তায় তাকাতেই দেখি-
খাপছাড়া আলোচনার চরম তর্কে
বেঞ্চে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে কয়েকজন  মানুষ,
উত্তেজিত হয়ে মাঝে মাঝে কান খাড়া করে ডেকে উঠছে
বেঞ্চের তলায় শুয়ে থাকা  দুটি নেড়ি কুকুর ।


জানলা দিয়ে আনমনে দূরের শীতল মেঘলা নীল আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
একটা কালো বিন্দু বড় হতে দেখি
তারপর সেই বিন্দুটাই বড় হয়ে একসময় কাক হয়ে যায়!
সেই একই কাকটা কিনা আমি জানি না?
তবে  কোন দ্বিধা ছাড়াই সেটি আম গাছের ঠিক আগের ডালেই বসল!
হয়তো যে কাকটা ফিরে আসার কথা না সেটি ঠিকই ফিরল,
অথচ যাদের ফেরার কথা থাকে তাদের কেউ কেউ  কখনোই ফেরেনা।


আমার বাবা যুদ্ধে যাবার আগে মাকে ছুঁয়ে  বলেছিলো,
“যুদ্ধ শেষে তোমার কাছে আর আমাদের অনাগত সন্তানের কাছে ফিরবোই”
‌অথচ বাবা কথা রাখেনি!
তাইতো প্রত্যেক বিজয় দিবসে আমার মা হাত-পা ছড়িয়ে
ঘরের মেঝেতে বসে বাবার জন্য চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন ।


সেদিন যারা ফিরেছেন আর এখনও বেঁচে আছেন-
তারা এই বিজয়ের দিন আসলেই হারিয়ে যাওয়া সহযোদ্ধাদের কথা মনে করে
মন খারাপ করে আমাদের বাসার সামনে চায়ের দোকানে বসে থাকেন সারাদিন।


চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে হাবিব চাচা জোড় গলায় বলতে থাকেন,
-সব কথা কি ভুলা যায়, রহিম ভাই?
আপনিই বলুন, আবার সব কথা কি মনে রাখা যায়?


আমি জানি, কিছু কথা থেকে যায় কিছু মানুষের বুকে,
আর কিছু কথা সব সময়ই হারিয়ে যায় বাতাসে।


বিজয়ের দিন এলেই আমার মা কাঁদতে বসেন,
দেশের স্বাধীনতার জন্য চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া আমার বাবার জন্য,
আর সারাদিন বাসার পাশের চায়ের দোকানে মন খারাপ করে সহযোদ্ধার জন্য বসে থাকেন হাবিব চাচা, রহিম চাচা।


আমি সেদিন মাঝে মাঝে দক্ষিনের জানালা খুলে একবার নীল আকাশ দেখি,
একবার মন খারাপ করে বসে থাকা হাবিব চাচা আর রহিম চাচাকে দেখি,
আর এক সময় মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে ‌অসহ্য হয়ে  কাঁদতে বসি-
এই জনমে না দেখা আমার হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য।
————————
র শি দ  হা রু ন
১০/১২/২০২২