একবার বালক বয়সে যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তার মোড়ে
এক জ্যোতিষীকে দেখেছিলাম আতশ কাচের নিচে মানুষের হাত দেখছে।
পাশে কাগজে সুন্দর করে লেখা ছিল-
মাত্র এক টাকায় হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলা হয়, বিফলে মূল্য ফেরত।


কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম,
জ্যোতিষী সবাইকে অবলীলায় খুশি করে দিচ্ছিল একই কথা বলে-
‘আপনার একদিন প্রচুর টাকা-পয়সা হবে।’
প্রতিবারই তার টিনের কৌটায় জমা হচ্ছিল এক টাকা করে।


স্কুলের টিফিনের জন্য মার দেওয়া এক টাকার নোটটার মায়া ত্যাগ করে
এদিক ওদিক তাকিয়ে
অনেকটা লজ্জা নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে জানতে চেয়েছিলাম,
‘আমি কি পালাতে পারব?’


জ্যোতিষী চমকে গিয়ে কিছু সময় ধরে আমার হাতের রেখা দেখল আতশ কাচের নিচে ফেলে
হাত থেকে তুলে সেই আতশ কাচ
আমার চোখ বরাবর ধরে রাখল কিছুক্ষণ।
একসময় প্রচণ্ড আকুলতা নিয়ে খুব নিচু স্বরে বলল,
‘বালক
তুমি জন্মের পরই পালিয়ে গেছ
তুমি কখনোই তোমার মাঝে ছিলে না।’


আমি সেদিন আর স্কুলে যাইনি
সারাদিন এদিক ওদিক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিলাম পলাতক আমাকে খুঁজতে।


তারপর থেকেই সারা জীবনই পালিয়ে যাওয়া আমাকেই খুঁজছি-
এমন কোথায়ও নেই যেখানে খুঁজিনি আমাকে!
জোনাকির আলোতে পুড়ে যাওয়া আকাশে
স্বচ্ছ ‌অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়া পুকুর জলে
ভেঙে যাওয়া কাচের টুকরোতে
একটি প্রাচীন বৃক্ষের দীর্ঘ বিষণ্ন ছায়াতে
রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মরচে পড়া এক আধুলিতে
অপরিচিত বারান্দায় বাতাসে দুলতে দুলতে থাকা কোনো এক লাল ওড়নাতে
আকাশে উড়তে থাকা ভয়ার্ত কাকের ডানায়
সমুদ্রের পারে এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা
হঠাৎ দেখা অজানা এক নারীর বাদামি চোখে
প্রিয় নারীর অভিমানে
দাদার কবরের মাটির গন্ধে
বুকের ভিতরে দাবড়ানো না লেখা কবিতার প্রতিটি শব্দে
অসংসারী হয়ে যাওয়ার প্রতিটি ইচ্ছেতে
মার শাড়ির আঁচলে
বাবার জায়নামাজে।


নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে
প্রচণ্ড ক্রোধে নিজেরই শরীরের ছায়া কতবার যে গলাচেপে ধরেছি
তবু পাইনি আমার খোঁজ।


আমার বন্ধু বাপ্পাদত্ত দেখা হলেই বলবে,
‘খুঁজতে থাক নিজেকে
পেয়েও যেতে পারিস একদিন
আর যদি কোনো দিনই খুঁজে না পাস নিজেকে
তবে তুই নির্ঘাত একদিন তুই কবি হবি
না হয় সন্ন্যাসী ।’
———————
র শি দ   হা রু ন
৩০/০১/২০২৩