ঝকাঝক ট্রেন চলছে
শুনতে পাই।
বাস চলছে পোঁ পোঁ শব্দে
শুনতে পাই।
ছোট-বড় সব গাড়ি চলছে
পিপিং পিপিং হর্ন বাজিয়ে
শুনতে পাই।
শুনতে পাই হেলিকপ্টারের বিকট শব্দ
উড়োজাহাজ, জাহাজ, লঞ্চ
এমনকি অযান্ত্রিক নৌকারও ফিনফিনে
শব্দ কানে আসে
মানব জন্মের কান্নার শব্দ আসে
জন্মের আনন্দে স্বজনের হাসি ভেসে বেড়াই আকাশে বাতাসে ;
মৃত্যু! শুধু মৃত্যুই আসে হঠাৎ এবং নীরবে ও নিঃশব্দে
চুপিচুপি জানান না দিয়ে।
মৃত্যু হয়েছে এমন খবরে স্বজনরা কাঁদে,
হাহুতাশ করে মাত্র অল্প কিছুদিন
তার পর সব ভুলে যায়, ভুলে যায় তার জীবন স্মৃতি ও
জীবনের সব লেনদেন।
আমি ভুলতে পারি না
এটা আমার একটা অযোগ্যতা বটে।
আমার মনে পড়ে আমার দাদীর কথা,
দাদার কথা মনে পড়ে না কারণ আমার বয়স তখন মাত্র দশ মাস।
আমার খুব মনে পড়ে আমার এক বড়মাকে
আপনারা নাম শুনেই চমকে উঠবেন হয়তো ;
তাঁর নাম ছিল অন্নবালা সাহা
জাতে হিন্দু কিন্তু একই রক্ত
লাল রক্ত।
আমার বাবা-মা বড় মা বলতে বলতেন
তাঁর একটি দোকান ছিল,
দোকানে ছিল নারকেলের লাড়ু, বাতাসা, মতিচুর লাড়ু ও
আরও হরেকরকমের মিষ্টান্ন
পঁয়ত্রিশ বছর আগেও
তার দোকানে উঠতে হতো গুনে গুনে
আটটা সিঁড়ি
দোকানের কাছেই ছিল একটা নারকেল গাছ
সে গাছের শোঁশোঁ শব্দে মানুষ ভয় পেত আঁধার রাতে
নারকেল ভাঙার শব্দও কানে আসতো
আমি দেখেছি সব কাজ তিনি প্রায় একাই করতেন
তাঁর একজন ছেলে ছিল
আমরা তাকে ক্ষুদু দাদা বলতাম
দাদার মতোই কখনো কখনো কোলে উঠিয়েছেন
আমি খুব কৃতজ্ঞ মানুষের মাঝে না পড়লেও
এ স্নেহের কথা ভুলতে পারিনা।
দোকানে গেলেই বড় মা বলতেন
"লে ব্যাটা কয়টা নারকেলের লাড়ু লিয়ে যা "
মাঝে মাঝে তেল কিনতে যেতাম
সঠিক মাপে দেওয়ার পরও
কাগে দু'চার ফোঁটা ঢেলে দিতেন
এটা ছিল ফাও
তখন সঠিক ফাও এর প্রচলন ছিল
আজ ফাওয়ের বদলে এসেছে "জোর যার মুল্লুক তার "
স্নেহের হাত মাথায় দিয়ে বলতেন
ব্যাটা আবার আসিস!
লাড়ুর লোভেই যেতাম আবারও
এমন স্নেহের কথা আর শুনি না
এখন শুধু শুনি তর্জন-গর্জন।
আমার খুব মনে পড়ে
আমার আরেক বড় মা কে
তাঁর নাম আমি জানিনা, সারাজীবন বড় মা বলেই ডাকতাম
সত্যিই তিনি বড় মা
আমার দুঃসময়ে আমার মুখে খাবার তুলে দিতেন তিনি
আচ্ছা,বলুতো আমি তাকে ক্যামনে ভুলি?
আমার ছোট মা, তিনিও চলে গেছেন তিন বছর আগে
ব্যাটা ছাড়া কোনদিনই কোন ডাক শুনিনি
তাঁর হাতেও খেয়েছি অনেক
এ-সব কি ভুলে থাকা যায়
ভুলে যাওয়া মানেই কি দায় এড়ানো নয়।
খুব করে মনে পড়ে
আমার সাবরেজিস্টার চাচার বাড়ির কথা
সেই পুরনো বাড়িটা
সেই ভাঙা ছাদের ঘর
জল ছাদের নীচে কত দুঃখের আয়োজন
আবার সেই বাড়ির বৈঠক খানায়
আমাদের পড়ালেখা ও অন্যকে পড়িয়ে দু’পয়সা কামানো
সেই কামাইে সংসারের দূঃখ লাঘবের চেষ্টা
আজ বড় হয়েছি
দু'চারটা স্বপ্ন দেখছি
সেটিও আমার আরেকজন বড় মা'র বদৌলতে
তিনিই আমাদের সেই বাড়িটি দিয়েছিলেন
পড়াশোনার কাজে
তাহলে আপনারাই বলুন
আমার এ-সব মনে রাখাটা কি আমার অযোগ্যতা?
যোগ্যতা বা অযোগ্যতার প্রশ্ন এখন আর নয়
এ-সবই আমাকে যতখানি পোড়াই
তারচেয়ে আনন্দ দেয় অনেক বেশি
সবার মুখচ্ছবি ভেসে উঠে আমার হৃদয়পটে
এবার আসি আবারো সেই সত্য ও সুন্দর মৃত্যুর কথায়
আমার সবাই চলে গেছেন নীরবে
আমরা সহসাই সবকিছু ভুলে যাই
ভুলে যাই বাঁচার তাগিদে
আজ সহসাই সবার কথা খুব করে মনে পড়ে গেল
আজ খুব কাছের একজন মৃত্যুর খবরে
হ্যাঁ,অরণ্য ইয়াকিন চলে গেছে
চলে গেছে অনেককেই কাঁদিয়ে
চলে গেছে একজন মানুষ
তারঁ মৃত্যুর রেজিষ্ট্রেশনে 'মানুষ' কথাটাই উল্লেখ থাকবে।
অরণ্য ইয়াকিন গল্প লিখতো
লিখতো কবিতা, পড়তোও খুব
গল্পগুলো থাকবে, কবিতাগুলো থাকবে
তাঁর একটি কিশোরী কন্যা থাকবে
তার সহধর্মিণী থাকবে
থাকবে চিরকাল তাদের দু'নয়নে জল
থাকবেনা শুধু সেই ছেলেটি, সেই মানুষটি।


#বেনাপোল
০২/১১/২০২০