কবিতাঃ  সবার দুর্গা
কবিঃ প্রনব মজুমদার


মাননীয় বরেণ্য কবি প্রনব মজুমদার মহাশয়ের এই “ সবার দুর্গা” কবিতাটি একটি  কথপোকথনের মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তোলা একটু ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন ভাবনার দারুন একটি শিক্ষণীয় কবিতা। আমি কবিতাটা পড়ে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ হয়েছি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে জল তরঙ্গের মতো ঢেউ খেলানো আবস্থায় গিয়ে পাড়ে গিয়ে ধাক্কা লাগছে ছলাত করে আলতো ভাবে। তাই মন আটকে যাবে সেই তীরে  “আদর ও শাসন দুটোই মা জানেন সময় সময়”।  কিন্তু যখন কবিতার সমুদ্রের সেই ঢেউয়ের উৎপত্তি স্থল থেকে আমি শুরু করতে গেলাম তখন দেখছি আমার নাখে মুখে নোনতা জল ঢুকে যাওয়ার অবস্থা।  তাই কবিতাটাকে নিয়ে একটু ময়না তদন্তে নেমে পড়লাম। চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক আমার অল্প কাব্যিক বিদ্যার পরিসরে কি তুলে আনতে পেরেছি।


পাঠকবৃন্দের সুবিধার্থে  পুরো কবিতাটি আমি এখানে উপস্থাপন করলাম-


ছেলে- স্নেহ কি?  
বাবা- তীব্র মায়া।
ছেলে- উহু! প্রোডাক্ট এর বাই প্রোডাক্ট মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে চাওয়া।  
বাবা- তবে বাবা মা কি?
ছেলে- পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন অফ মেল-ফিমেল
শারীরিক চাহিদা ও মানসিক শান্তির তালমেল।
কোম্পানি- মা দুর্গা এন্ড সিস্টার্স  
স্ত্রী- মা দুর্গাকে নিয়ে ঠাট্টা?
বাবা ও ছেলে উভয়ই- মা’র সাথে হাসি মজাক করায় যায়
মা’র মতো সাচ্চা বন্ধু কেউ কি হয়?
আদর ও শাসন দুটোই মা জানেন সময় সময়।
বোলো দুগগা মাই কি জয়- আসছে বছর আবার হবে।  


এখানে দেখুন, মাননীয় কবি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রথমেই ছেলেকে দিয়ে প্রশ্ন করালেন। কারন স্নেহ ভাজনদেরই কৌতূহলী মন বাবার কাছে। প্রায় দেখবেন ছোট বাচ্চার সঙ্গে যদি থাকেন সে আগেই প্রশ্ন করে বসবে এটা কি? ওটা কি? কেন হল? ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবতই বাবা প্রথমে ছোট করে উত্তর দেন। বিস্তারিত আলোচনায় যান না। যেমন ধরুন বাচ্চা প্রশ্ন করল আমি কি করে এলাম? বাবা এখন কি উত্তর দেবেন? তাই ছোট করে উত্তর দেন, তোকে একটা পরি এসে রেখে দিয়ে গেছে।  বেস এই টুকুই। ঠিক তাই এখানে বাবা ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছেন  “তীব্র মায়া”। যদিও এই  “স্নেহ” এবং “ মায়া” কি এর বিশ্লেষণ করলে রাত ভোর হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু বাচ্চা তো বাপেরও বাপ থাকে!  ঠিক এখানে সেই রকম এক ছেলের সঙ্গে পড়েছে এক বাবা। তাই ছেলে এখানে বাবার উত্তরটাকে আরও গভীর পর্যায়ে নিয়ে গেছে নিজের মতো করে “ প্রোডাক্ট এর বাই প্রোডাক্ট মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে চাওয়া।  অর্থাৎ পিতা পুত্রের মধ্যে স্নেহ মায়াটি হচ্ছে নিজের ছায়াকে পুনরায় দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই “নিজের ছায়া দেখতে চাওয়া” কথাটির মধ্যদিয়ে কবি সুন্দর ভাবে তীব্র আকাঙ্ক্ষার একটি রূপ দিয়েছেন। আর এই আকাঙ্ক্ষা মায়া’র রসে সিক্ত। এখানে কবি “প্রোডাক্ট এর বাই প্রোডাক্ট” কথাটির মধ্যদিয়ে বংশ পরম্পরা  অর্থাৎ ছেলে নাতি, নাতির ছেলে এই ভাবে একের পর এক  “প্রোডাক্ট এর বাই প্রোডাক্ট” এর মধ্যমে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ। আধুনিক ছেলে, তাই সে ট্যাকনিক্যাল ভাষায় উত্তর দিয়েছে “প্রোডাক্ট এর বাই প্রোডাক্ট” মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে চাওয়া।  


এবার বাবা দেখছে ছেলে তো আমার উপরে গান করতে শুরু করেছে। তাই এবার বাবা এখানে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মানে মনে ভাবছে দেখি তো ছেলে এবার কি উত্তর দেয়। তাই তিনি প্রশ্ন করে বসলেন তাহলে বলতো “তবে বাবা মা কি?”। বাবা ভাবছে এবার ছেলেকে জব্দ করা গেছে। এবার আমকেই সে উত্তর জিঞ্জাসা করবে আর আমি ওর মতো ঘুরিয়ে প্যাঞ্ছিয়ে উত্তর দেবো। কিন্তু ছেলে তো এক কাঁটা উপরে, তাই সে আগের থেকে আরও কঠিন করে উত্তর দিয়ে বসল-
“পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন অফ মেল-ফিমেল,  
শারীরিক চাহিদা ও মানসিক শান্তির তালমেল”।
এবার বুঝুন বাবা মা কি?  
এই “পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন” হচ্ছে এক জটিল গাণিতিক পদ্ধতি। সংখ্যার একটি গোষ্ঠীকে একটি সেটে নির্বাচন করে উপসেট গঠন করা হয়। অর্থাৎ এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর তথ্য সাজানোর বিভিন্ন উপায় বের কারান হয়। যাই হোক এখানে সেই ফারমুলা নিয়ে আর বেশি এগাব না। না হলে ম্যাথম্যাটিকসের সঙ্গে স্ট্যাটিস্টিক এর ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। কবি এখানে এই “পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন” এর সঙ্গে সুন্দর ভাবে যে লাইনটা যুক্ত করেছেন সেটি হল “ অফ মেল-ফিমেল’। অর্থাৎ এই সাজানোর ব্যাপারটা কোন সংখ্যা দিয়ে হবে না। হবে পুরুষ এবং মহিলা দিয়ে। তাহলে বোঝায় যাচ্ছে এই জগতে পুরুষ এবং মহিলা মিলে যে একটা সংসার তৈরি হচ্ছে এটা কিসের দ্বারা “পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন অফ মেল-ফিমেল”। আমরা প্রায় বলে থাকি তোমার ভাগ্যে সে লেখা নেই তাই তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হল না।  বা বলি এদের রাজ যোটক। এই যে কে কার সঙ্গে সংসার বাঁধবে, কে কার ভাগ্যে লেখা আছে,  এই ভাগ্যের লিখনটাকে কবি  সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছেন একটা লাইন দিয়ে-“পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন অফ মেল-ফিমেল”। আর এই জটিল গাণিতিক পদ্ধতি উপরে বসে কে প্রয়োগ করছে সেটা কি আর বলার দরকার। তার পর একে একে দুই হয়ে যাওয়ার পার সমান চিহ্নের ডানদিকে কি হবে কবি বলেই দিয়েছেন- “শারীরিক চাহিদা ও মানসিক শান্তির তালমেল”। এবার বুঝতে পারছেন কি জটিল কাব্য কবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। ধন্য কবি ধন্য।


আবার কবি গভীর ভাবনার অতল থেকে একটা লাইন তুলে দিলেন-    
“কোম্পানি- মা দুর্গা এন্ড সিস্টার্স”। এখন এই মা দুর্গা এন্ড সিস্টার্স” কেন কবি বললেন। কেন মা দুর্গা এন্ড শিব” বললেন না। বা মা দুর্গা এন্ড কং” বলতে পারতেন, কিন্তু সেটাও বললেন না। তিনি বললেন “মা দুর্গা এন্ড সিস্টার্স”।এটা গভীর ভাবনার বিষয় আছে। চলুন খুজে বার করানোর চেষ্টা করা যাক কি আছে এর মধ্যে। দেখুন আমরা সবাই দুর্গাকে মা বলি। তাহলে আমরা সবাই একে অপরের ভাই বোন। আমিও মা বলছি আর আমার সঙ্গে “পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন অফ মেল- ফিমেল” দ্বারা যার গাণিতিক মিল হবে সেও মা বলে। কিন্তু এক্ষেত্রে সে আমার “ সিস্টার্স”। যেহেতু বাবা ছেলে সঙ্গে কথা হচ্ছে তাই স্বভাবতই  “মা দুর্গা এন্ড সিস্টার্স” কথাটা উঠে এসেছে। যদি মা মেয়ের মধ্যে কথা হতো তাহলে হয় তো “ বাবা ভোলেনাথ এন্ড ব্রাদার্স” হতো (আমার ব্যক্তিগত ধারনায়)।  আর এই যে আমরা সবাই দুর্গাকে মা বলি এর দ্বারায় “সবার দুর্গা” কবিতার নামকরণের স্বার্থকতাও এখানে সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।


আবার মা দুর্গাকে নিয়ে যখন বাবা ছেলের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে গভীর কাব্যিক ও আধ্যাত্মিক বাক্যালাপে তখন স্ত্রী কিছু বুঝুক আর না বুঝুক এসেই ঝাড় শুরু- মা দুর্গাকে নিয়ে ঠাট্টা?। যেটা কারো কারো সংসারে মাঝে মাঝে হয়ে থাকে। তৃতীয় ব্যাক্তি অর্ধেক শুনেই বলে বসে ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ইরাকি হচ্ছে? তখন নিরুপাই হয়ে বলে থাকি না না এই তুলসি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তুলসি পাতা খেলে শরীরে প্রচুর উপকার হয়। সেই ভাবে এখানেও  বাবা ও ছেলে উভয়ই খুব নম্র ও মিষ্টি ভাবে এক সঙ্গে মায়ের গুণগান করে বলে বসল “মা’র সাথে হাসি মজাক করায় যায়, মা’র মতো সাচ্চা বন্ধু কেউ কি হয়? আদর ও শাসন দুটোই মা জানেন সময় সময়। একদম সত্যি কথা মায়ের মতো বন্ধু হয় না। আবার মা ঠিক জানেন কখন আদর করতে হয় আর কখন শাসন। কবি সুন্দর ভাবে কবিতার সমাপ্তি করেছেন। বোলো দুগগা মাই কি জয়- আসছে বছর আবার হবে।


মাননীয় বরেণ্য কবিকে আমার শ্রদ্ধা জানাই। এমন সুন্দর একটা গভীর মননশীল চিন্তার কবিতা উপহার দেওয়ার জন্য।


কবিতার সাগরে ডুব দিয়ে যত গুলো মনি মুক্ত পেয়েছি সবই আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এবার আপনারাই বিচার করবেন আমার ডুব দেওয়ার স্বার্থকতা। সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন । সুন্দর থাকুন। এই কামনা করি।

[কবিতা পড়ে আমার একান্ত নিজের অনুভূতির প্রকাশ করলাম। আপনাদের সকলের মুল্যবান মতামতের অপেক্ষায় রইলাম ]