প্রিয় উসা,
এই প্রথম তোমাকে তোমার নামে সম্বোধন করলাম।
এতোদিন নানা নামে ডেকেছি,কখনো এটা,কখনো ওটা।
কিন্তু তোমার নিজের নামে কখনো ডাকা হয়নি।


সামনাসামনি যতদিন বসেছি,কথা বলেছি,হাতে হাত রেখেছি,চোখে চোখ,কিন্তু নাম ধরে ডাকা হয়নি। তুমিও না। আমরা আমাদের নাম মুখে আনিনি কখনো।


আমার লেখা কবিতায়,গল্পে বা চিঠিতে নানা নাম পড়ে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়েছে জানি। হয়তো এমনও মনে করেছে কেউ কেউ,কারো প্রেমিকাকে বুকের মধ্যে গোপনে রেখে নিজের প্রেমিকা ভেবেছি।কারো সুখ কে নিজের সুখ ভেবে গোপনে রেখেছি বুক পকেটে। এভাবেই হয়তো আছি,কারো কারো ভাবনায়।


অথচ আমাদের ভালোবাসা,আমাদের প্রেম সারি সারি চারাগাছের মত আমরা আমাদের বুকে রোপণ করেছিলাম।
খেয়াল করেছো নিশ্চয়ই, বলেছি,করেছিলাম।
অনেকদিন একাকি সেইসব প্রেমের চারাগাছের শেকড়ে জল ঢেলেছি,একদম একা।
আমার পাশে কেউ ছিলো না,তুমি না,এমনকি তোমার ছায়াও নয়।


এখানে একজন নারী ছিলো,চারাগাছ রূপে,যা কোনদিন আর বৃক্ষে পরিণত হবে না।
তুমি তাকে চেনো,তুমি তাকে জানো।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে তুমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাও।
আচ্ছা, কেমন লাগে তখন তোমার চিবুকের তিল?


এখানে প্রেম আছে, কিন্তু প্রেমের সুর নেই।
এখানে নিসর্গ-সৌন্দর্য আছে,কিন্তু আকাশ ভর্তি মেঘ,
এখানে সারি সারি গাছ,ছোট ছোট পাহাড়ের মত টিলা,ঝর্ণা,লেবু বাগান আছে, আর আছে অশ্রু বিন্দু।
বৃষ্টি এলে আমি খুব সুখী হই,কেউ বোঝে না,টের পায় না অশ্রু বিন্দু।


এখানে শহরতলী আছে,যেখানে আমি থাকি।এখানে সমুদ্র আছে,যেখানে রোজ একবার পা ভেজাই ।
এখানে সাঁকো আছে, প্রধান সড়ক থেকে সমুদ্র অবধি যাবার,
এখানে সুরঙ্গ আছে,সীমান্ত রেখা আছে,সীমানা প্রহরীরা আছে।
সুপারি বাগান আছে,আছে তার মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ।
সেই পথ ধরে আগে,বেশ আগে কথা কইতে কইতে হাঁটা যেতো।
এখন কথা কইনা। হেঁটে যাই প্রায়ই,ওপথে হাঁটার অনুমতি লাগে না,কথা কইতে লাগে কিন্তু এমন কেউ থাকেনা আশেপাশে যার কাছ থেকে কথা কইবার অনুমতি নেয়া যায়।


এখানে সকলের বুকের মধ্যে অপার্থিব ভালোবাসার নহর আছে। আমি সেই সব প্রেম,সেই সব স্বাপ্নিক মানুষ আর সেই সব রূপকথা ভালোবাসার মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম, যে মৃত ভালোবাসার কংকাল নিয়ে পড়ে আছি।


এখানে বারো বছর আগে চলে যাওয়া আমার সাবেক প্রেমিকাও আছে। তার সাজানো বাগানে আমি নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যাই,সে আসে।
তার চোখে মুখে অহংবোধ দেখে আমার একধরনের করুণা হয়। সেটুকু গোপন করে হাসি হাসি মুখ করে আমি অবলীলায় চা পান করি, ঠোঁট লাল করে তাম্বুল খাই।আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি,বারো বছর আগের সেই আমিকে তার মনে আছে কিনা।থাকার কথা নয়,যেমন আমার নেই।
থাকলেই কী লাভ বল?
আমি কি পারি পিছিয়ে যেতে বারোটি বছর?
তিন বছরের অজ্ঞাতবাস আমি কী করে ভুলে যাই?
কী করে ভুলি সু-উচ্চ পাহাড়?
কী করে ভুলি পাহাড়ি চোলাই,সাঙ্গু কিংবা সুলক্ষণা?


ফেরি প্রশ্ন করেছিলো এখানে কেন আছি!?
তাকে বিশ্বাস করানো কঠিন, এখানে আছি পেটের দায়ে। কাজ বলতে যা জানি তা এখানে ছাড়া অন্য কোথাও করতে পারবো না যে!
ও এটা মানতেই পারে না।
ওর ধারণা আমি এখানে আছি একটা সুপাড়ি বাগানের জন্যে।
ও ভেবে বসে আছে আমি এখানে থাকি কারো স্বপ্নে ভালোবাসা হয়ে থাকার জন্যে।
ওর বিশ্বাস, আমি শুধু এখানে থেকে যাওয়ার জন্যেই জন্মেছি।
ওর ধারণা,এখন আমি চারাগাছ,একসময় মহীরুহ হবো বিশাল।


অথচ ও এখন পর্যন্ত বুঝতেই পারেনি,তোমার বুকে লাগানো সবগুলো চারাগাছ তুমি উপড়ে ফেলেছো। তুমি অন্যের স্বপ্নকথা হওয়ার জন্য নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছো।
তোমার চন্দন চর্চিত মুখ,তোমার মেঘের মত চুল,অন্য কারো জন্য প্রস্তুত।
তোমার স্বপ্ন আর ভালোবাসার মধ্যে আছে এমন এক রূপকথার মানুষ যার সাথে আমার কোন মিল নেই।
অথচ,তোমার করবিতে আমিই গেঁথেছিলাম বর্ষার প্রথম কদমফুল।


ফেরি জানে না,এখানে সারবাধা গাছের মত আমিও একটি গাছ।
নড়াচড়া নেই,স্থবির এবং চলৎ শক্তিহীন।
এই গাছে কোন ফুল ফোটে না।
এই গাছের কোন পরিচয় নেই।
এই গাছে কোন ফল ধরে না।


শুধু দাঁড়িয়ে আছে,শেকড়ে কিছুটা মাটি এখনো অবশিষ্ট আছে বলে। কোন এক বৃষ্টিতে মাঠিটুকু ধুয়ে গেলে,গাছটিও মুখ থুবড়ে পড়বে মাটির বুকেই।
তখন তুমি কেঁদোনা যেন!


ভালো থেকো।
অনন্ত।
মরিচ্চ্যা বাজার,উখিয়া থেকে।
০৫/১০/২০২৩।।