বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যে এক দুরলঙ্ঘনীয় বাধা বা উচ্চতার নাম “রবীন্দ্রনাথ” । জীবন ও সাহিত্যের সামগ্রিকতাকে তিনি সুনিপুনভাবে তার লেখার শরীরে ধারণ করছেন । এমন কোন মানবীয় অনুভূতি নেই যা তার লেখায় উঠে আসেনি । এই বহুমাত্রিকতার পাশাপাশি জীবনবোধের গভীরতা ও ভাষার পরিপূর্ণতায় তার লেখা হয়ে উঠেছে কালজয়ী । কবিগুরুর লেখাকে কয়েকটি বিভাগ, সেসব বিভাগের আবার কয়েকটি উপ বিভাগে ভাগ করে উল্লেখ করতে হয় । সেগুলোর ভেতর প্রথমতঃ আরাধনা বা পূজা পর্যায়, তারপর প্রেম, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা । এই প্রেমের আবার উপ উপ বিভাগ আছে । নর নারীর প্রেম, মানব প্রেম, প্রকৃতি ও জীবে প্রেম, সৃষ্টিকর্তার প্রেম, প্রেমের পাশাপাশি আবার চলে আসে বিরহ, বিরহ থেকে কষ্ট, কষ্ট থেকে পরিশুদ্ধি, সে এক এলাহি ব্যাপার । বাংলা সাহিত্য অঙ্গনকে উনি যেন পৈতৃক জমিদারী বানিয়ে ফেলেছেন, বাংলা সাহিত্যকে উনি এতোটাই সমৃদ্ধ করে গেছেন যে যাই লিখতে যাই দেখা যায় উনি সেটা আগেই লিখে রেখে গেছেন। তাই কবি দীনেশ দাস বলেছিলেন, “তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা”। উনার মহা প্রয়াণের ভেতর দিয়ে ১৯৪১ সালের ২২ শে শ্রাবণ বাংলা সাহিত্যাকাশে যে শূন্যতা, যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা অন্যান্য ক্ষতের মত শুকিয়ে যায়নি, সময়ের বিবর্তনে তা কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে । তার বিকল্প বা কাছাকাছি মানের এমন সামগ্রিক কাউকেও আমরা আজও পাইনি । কোন দিন পাবো কিনা তাও জানিনা ।


রবীন্দ্র বিদ্বেষী ও মৌলবাদীরা যে দুটো দিকে রবীন্দ্র নাথের দিকে তাদের সঙ্কীর্ণতার তীর ছুড়ে দেয় তার প্রথমটি হল ধর্মান্ধতা, তাকে হিন্দু কবি বা তার রচনাকে হিন্দুয়ানী বলে হেয় করার অপচেষ্টা । কিন্তু তার লেখা দিয়ে উনি স্থান, কাল, পাত্র, জাত, পাত ইত্যাদির অনেক উপরে উঠে গেছেন। দ্বিতীয়টি হল রবীন্দ্র নাথ ছিলেন ধনীর দুলাল । উনাকে জীবন যুদ্ধের কষ্ট, অন্ন বস্ত্রের কষ্ট সহ্য করতে হয়নি । দীর্ঘ জীবনে উনি নিরবিচ্ছিন্ন সাহিত্য চর্চা করতে পেরেছেন যা বেশিরভাগ সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না । বেশীর ভাগ ঝঞ্জাক্ষুব্ধ লেখকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা জীবন যুদ্ধ্যে বা সম্পর্কের ভাঙ্গনে যে আঘাত পেয়েছেন তাই তাদের লেখার উপজীব্য হয়ে উঠেছে । কিন্তু রবীন্দ্র নাথ এমন কোন একমাত্রিক লেখক নন । উনি সমস্ত মানবীয় অনুভূতিকে এক জীবনে এমন ভাবে স্পর্শ ও লালন করেছেন যে উনি একের ভেতর হয়ে উঠছেন বহু, সীমার ভেতর থেকে হয়ে উঠেছেন অসীম । এই খানেই মূলত অন্য লেখকদের সাথে রবীন্দ্রনাথের মুল পার্থক্যটা তৈরি হয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথের নাম শুনলে তাইতো রবীন্দ্র মুগ্ধ বিস্ময়ে কবিতার ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়ঃ


“আঁকতে আমার ভীষণ ভয়, আঁকতে থাকি তলস্তয়।
আঁকতে আঁকতে থামিয়ে হাত, তাকিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ।
আঁকতে আমার ভীষণ ডর, আঁকতে থাকি শেক্সপীয়র ।
আঁকতে আঁকতে অনেক রাত, তাকিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ।
আঁকতে আমার ভীষণ লাজ, তবুও যখন আকাই কাজ।
আঁকতে আঁকতে কিস্তিমাত, তাকিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ।