‘যে কবির পক্ষে অনুবাদ কর্ম তাঁর স্বার্থেরই সংলগ্ন, এবং নিজ কর্মের সহায়ক শিক্ষা, সংযম, আত্মশোধনের জন্য উৎকৃষ্ট একটি উপায়: ভালো অনুবাদও দৈবাধীন, কোনো এক রকম প্রেরণার মুখাপেক্ষী, কিন্তু অনুবাদে চিন্তার অংশটা অন্যে জুগিয়ে দেয় বলে, কবি তাকে প্রায় একটা প্রকরণগত সমস্যায় পরিণত করতে পারেন, অনেক বেশি নির্ভর করতে পারেন, ভাষা, ছন্দ, মিল ইত্যাদিতে তাঁর পরিশ্রমী দক্ষতার উপর। যদি এজন্য তাঁকে জর্মান আর সংস্কৃত অভিধান ঘাঁটতে হয়, পড়তে হয় মূল লেখকের জীবনী অথবা সময়ের ইতিহাস, এ সব কাজ তেমনি তৃপ্তিকর হবে তাঁর পক্ষে, যেমন ভাস্করের পক্ষে বলবিদ্যা। যখন স্বকীয় ভাবে বলার কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন সময় সব কবিরই আসে, তখন পুরনো কথার পুনরাবৃত্তির বদলে অনুবাদকর্মই শ্লাঘনীয়; তাতে চর্চার এবং ব্যায়ামের সুযোগ মেলে, ‘হাত, ঠিক থাকে, লেখক একটা নিয়মের অধীন হ’য়ে অপচয় থেকে রক্ষা পান, এবং সেই সচেষ্টতার ফলে হয়তো কবিতার প্রকৃতি বিষয়ে একটু তীক্ষ্মতর দৃষ্টি, কলাকৌশলে আরো নিশ্চিত একটু নৈপুণ্য তাঁর আয়ত্তে আসে যে উপার্জন তিনি সুদে খাটাতে পারবেন পরবর্তী  স্বকীয় রচনায়।’


অনুবাদ এবং অনুবাদকের মধ্যে কত দূর কী সম্বন্ধ থাকে বা একজন সৃষ্টিশীল কবির পক্ষে কী কারণে অন্যের কাব্য অনুবাদের কাজে আগ্রহী হওয়া স্বাভাবিক এই সম্পর্কে ঐ বক্তব্যটি উল্লেখ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। অনুবাদ সাহিত্য বা অনুবাদিত সাহিত্যের যে সাড়া জাগাতে পারে তা বুদ্ধদেব-কে না পড়লে বোঝা সম্ভবপর হ’য়ে উঠে না। বুদ্ধদেব, তিনিই একমাত্র কবি যিনি সর্বাধিক অনুবাদিত সাহিত্যে সৃষ্টি করেছেন বাঙলায়। তাঁর মতো এতো ব্যাপক সংখ্যক সাহিত্য অনুবাদ করেনি অন্য কেউ। বিশেষ ক’রে যে দু’টি অনুবাদ পৃথক দুটি গ্রন্থ হিশেবে রয়েছে। আমি যে দু’টির নাম উল্লেখ করতে চাই: “মেঘদূত” এবং “শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা”। তিনি শুধু অনুবাদই করেননি, সংযুক্ত করেছেন জীবনপঞ্জী এবং প্রয়োজনীয় পাদটীকা। আমি মনে করি, যে কোনো অনুবাদিত গ্রন্থের জন্য এ দু’টি খুবই প্রয়োজনীয় হ’য়ে দেখা দিতে পারে। যা দেখা যায় না অন্যে কারো মধ্যে। বাঙলায়, যাঁরা কবিতা লিখেছেন বা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাঁরা কোনো না কোনো সময় সাহায্য নিয়েছেন বাইরের সাহিত্যের। আর এর পিছে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে অনুবাদিত সাহিত্যে। অনুবাদ সাহিত্য সর্বকালে এবং সময়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অন্যের নিকট, তা যদি হ’য়ে থাকে উৎকৃষ্ট মানের অনুবাদ।


তাঁরা মনে করেছে তাদের নিকট সর্বকালে এবং সর্বসময়ে দেখা দিবে নতুন কবিতা, যার জন্য তাঁরা সময় নষ্ট করতে চাননি অনুবাদ কবিতার জন্য। অনুবাদ কবিতা বজায় রাখে মৌলিক কবির ‘ভাব’, ‘ভাষা’, এবং ‘ছন্দের’- যার ফলে ওই কবিতা ‘অনুবাদিত কবিতা’ কবির স্বকীয় স্বতন্ত্রবোধ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। যেমনটা সুধীন্দ্রনাথ এবং বুদ্ধদেবের দিকে চোখ নিলেই দেখতে পাই অনুবাদ কবিতা বাঙলায় দেখা দেয় ঝড়ের মতো, কিন্তু তা দেখা দেয় না মৃদু প্রবাহিত হওয়ার মতো, যা স্পর্শ করতে পারি ধীরে ধীরে। কয়েক দশক কেটে যাওয়ার পরও বাঙলায় পাওয়া যাবে না এমন কোনো কবির উৎকৃষ্ট মানের অনুবাদগ্রন্থ, যা গ্রহণযোগ্য হ’য়ে উঠতে পারে সর্বজনস্বীকৃত। তার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা মৌলিক কবিতা সৃষ্টির সোপন তৈরিতে মগ্ন রয়েছেন।


পশ্চিম বাঙলায় যতো সংখ্যক অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ পায় এই বাঙলায় প্রকাশ পায় না তার অর্ধেক-ও। তবে কী বলা যায় না ওই দিকে আমাদের মনোযোগ বা আকর্ষণ খুব কম বা নেই বললেই চলে। বুদ্ধদেব তাঁর ‘শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতার’ ভূমিকায় উপস্থাপন করেন এক দীর্ঘ আলোচনা, যা বোদলেয়ারকে করে নিকট থেকে নিকটতর আর অজানা থাকে না বোদলেয়ার সম্পর্কে। শুধু বোদলেয়ারই নন; আরো ব্যাপক এবং গভীরভাবে উপস্থাপন করেন আধুনিক বাঙলা কবিতা সম্পর্কিত ব্যাপারগুরো, যা সাহিত্যেয় অজ্ঞেয়। রোম্যাণ্টিক কবিদের ভালোলাগা না লাগা এবং তাদের কবিতা সৃষ্টির সারবস্তুু তিনি ফিরে ফিরে এনেছেন এই আলোচনায়। বাদ দেননি রবীন্দ্রনাথকেও। বুদ্ধদেবের এই অনুবাদিত কবিতা সমূহে শুধু অনুবাদ কবিতা-ই হ’য়ে থাকে না, বরং তা ধরা দেয় স্বপ্নময় একজগত হ’য়ে। যে জগতে বিচরণ করা যায় ক্লান্তহীনভাবে দীর্ঘক্ষণ। বোদলেয়ারের এই অনুবাদিত কবিতার শেষে পাওয়া যায় দীর্ঘ পৃষ্ঠাব্যাপী কিছু টীকা, যা করা হয়েছে বোদলেয়ারের প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থের কবিতার পঙ্ক্তির অজানা শব্দ থেকে। তাঁর প্রকৃত অর্থদ্বারের জন্য মূল্যবান ক’রে তোলে গ্রন্থটিকে।


সবচেয়ে বড় কথা এই টীকা পড়া মাত্র কবিতাগুলো বুঝতে সহজ হ’য়ে যায়। বুদ্ধদেবের এই অনুবাদিত কবিতার শেষে পাওয়া যাবে ‘বোদলেয়ারের জীবনীপঞ্জি; যা বোদলেয়ারের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাই উঠে আসে। জীবনীপঞ্জির কিছু কিছু ঘটনা আমাকে ব্যথিত ও বিস্ময় ক’রে তোলে। বুদ্ধদেব বসু, শুধু বোদলেয়ার এবং সংস্কৃত ভাষা থেকে মেঘদূত অনুবাদ করেই থেমে থাকেননি। যেহেতু তিনি পূর্বেই বলেছেন, একটা সময় পর্যন্ত, যতোক্ষণ কোনো কবিতা ধরা না দেয় সেই সময় পর্যন্ত তিনি চালিয়ে থাকেন অনুবাদ কর্ম। তাই অনুবাদের পর অনুবাদ করতে থাকেন ‘হ্যেন্ডালিনের কবিতা’, রাইনে মারিয়া রিলকের কবিতা’, ‘চীনে কবিতা’, ‘মার্কিনি কবিতা’ এবং ‘বরিস পাষ্টেরনাক: জিভাগোর কবিতাগুলো’ পূর্বের মতো সমস্ত কিছু এনেছেন এই কবিতাগুলোতে। প্রত্যেকটি অনুবাদের পূর্বে ব্যাপকারে এনেছেন জীবনপঞ্জি, ভূমিকা এবং টীকা। যা কবি এবং কবিতা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আরো দৃঢ়বদ্ধ করে। আরো বেশি আকর্ষণ করে। তিরিশি কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু, এতো পরিমাণ কবিতা অনুবাদ করেছেন, কোন কালে বা কোন সময়ে এতো পরিমাণ কবিতা অনুবাদ করেনি অন্য কেউ। অন্য অনেকের হ’য়ে যা করেছেন তিনি একা।


বুদ্ধদেব বসুর ওই কবিতাগুলো শুধু-ই অনুবাদিত কবিতা হ’য়ে দেখা দেয় না; বরং তা দেখা দেয় অদ্বিতীয় কবিতা হ’য়ে। যা আকৃষ্ট করতে পারে সকলকে। সুধীন্দ্রনাথ যেমন অনুবাদের সময় বেছে নেন ‘শেক্সপীয়রের সনেট’, ‘জন মেসফীলড’, ‘সীগফ্রিড সমুন’ বা জার্মান ভাষার ‘হান্স্ কারোমা’, ‘হাইনরিখ হাইনে’, ‘গ্যেটে’ বা ‘ফরাসী ভাষার ‘ভালেরি’, ‘মার্লামে’ ইত্যাদি। সুধীন্দ্রনাথ, যিনি অনুবাদের সময় বেছে নেন কয়েক সংখ্যক কবির স্বল্পসংখ্যক কবিতা। যেমন অজ্ঞাত রেখে দেন জীবনপঞ্জি ও ভূমিকা বা টীকা। যা বুদ্ধদেব করেননি। তাই বুদ্ধদেব সর্বদা আমার কাছে দেখা দেন অদ্বিতীয় অনুবাদক হিশেবে। যাঁর অনুবাদ কবিতা আমার হৃদয়চিত্তে দোঁলা দেয় সর্বদা।


‘অনুবাদক সর্বত্রই অদ্বিতীয়’ সুধীন্দ্রনাথের-এ উক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার ঘটে থাকে যেন বুদ্ধদেব বসুর কাছে। বিশ্বের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ-ই বাঙলায় দেখা দিতে পারে অনুবাদের মাধ্যমে। যে রকম দায়িত্বপূর্ণ কার্যগুলো সম্পাদনের জন্যে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে একদল অনুবাদকের। যাঁরা শুধু কবিতাই নয়, অন্য যে কোনো সৃজনশীল গ্রন্থও অনুবাদে সক্ষম। আমি মনে করি, কবিরাই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে সবার আগে। তাদের পথ ধরে অন্যেরা আসলে আরো ভালো হয়। কালের বা সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেছে কোনো মননও সৃষ্টিশীল গ্রন্থই সীমাবদ্ধ থাকেনি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের ভিতর, বরং তা অনুবাদের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত বিশ্বজুঁড়ে। এবং চাহিদা বেড়েছে ওই গ্রন্থটির, যা ব্যাপকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের মেধা ও মননে। এক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করতে পারি। বরীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের জন্যে পরিচিতি পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। যখনও আমরা বাঙলায় ঠিকমত চিনে উঠতে পারিনি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে। তাই এই সময়ে ব্যাপকহারে অনুবাদিত সাহিত্যের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশ্বের আলোচিত ও সমালোচিত গ্রন্থটির বাঙলায় আগমন ঘটাতে হবে অনুবাদের মাধ্যমে। অনুবাদিত সাহিত্য সৃষ্টিতে মৌলিকতা কখনও ব্যাঘাত ঘটায় না বরং এর ফলে মৌলিকতা হ’য়ে উঠে দৃঢ়। যা, যে কোনো সাহিত্যে সৃষ্টিতে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে সক্ষম।


বাঙলা সাহিত্যে হ’য়ে উঠুক আমাদের প্রাণের সাহিত্যে। এ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন কালের এবং সময়ের পরিক্রমায় অনেক কবি ও সাহিত্যিক। আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে অনুবাদের দিকে তা দেশের বা যে ভাষার-ই হোক না কেন তা দেখা দিক বাঙলা ভাষায় রূপান্তর হ’য়ে।