সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার মধ্যে থেকে কবিতা-গান আর নাটকেই স্বদেশ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সযেন সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের দিকে চোখ রাখলে সেটা যেন আরও অনেক বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠে। গল্প ও উপন্যাসে সেই চেতনার প্রভাব রয়েছে খুবই কম। আবার এটাও দেখতে পাই যে, প্রবন্ধে তার কোন ছায়া নেই বললেই চলে। তবে অনেক সময় দেখা যায়, সেই সব প্রবন্ধে, অনেকটাই রাজনৈতিক আলোচনা নির্ভর। যেভাবে স্বদেশ চেতনার কোন উপস্থিতি নেই। আবার এটাও সত্য যে, নাটকের চেয়ে দেশাত্মবোধক গানে, সেই চেতনার প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন ভাবে, বৈচিত্র্যময় রূপে। যা অতি সহজে পৌঁছে যেতে পারে মানুষের একদম মনের গভীরে। যেন ফিরে আসা কোন সুর অতি সহজে বেঁধে দিয়ে যায় তার মননে। এ-কথা বলে নিতে পারি যে, স্বদেশী আন্দোলনের যুগে, এবং তার পরবর্তী সময়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রচারিত সেই সঙ্গীত ও কবিতায় তার প্রভাব রয়েছে অনেক বেশী। নবীন সেনের পলাশী যুদ্ধের যুগ থেকে আধুনিক কালের নজরুল, প্রেমেন্দ্র, সুকান্ত পর্যন্ত এই ধারা মিশে রয়েছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে, বয়ে চলা কোন এক নির্দিষ্ট দিকে। নিষিদ্ধ ধারার দিক থেকে কেউ-ই যেন বাদ পড়েনি। কি কবিতা, কি গান বা উপন্যাস। সেই শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অজস্র বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। প্রথমেই উল্লেখ্ করতে পারি ১৯১০ সালে ‘বন্দনা’ শিরোনামে দু’টি বাজেয়াপ্ত কাব্যগ্রন্থের নাম। ‘বন্দনা’ প্রকাশিত হয় দু’খণ্ডে। প্রথম খণ্ডের লেখক পূর্ণচন্দ্র দাস, আর দ্বিতীয় খণ্ডের লেখক হলেন হরিচরণ মান্না। ১৯১০ সালের ৮ই আগস্ট, গেজেট ঘোষণায় বই দু’টি বাজেয়াপ্ত করা হয়। উক্ত বই দু’টি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। তার পরবর্তী সময়ে, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় ‘স্বদেশ গাথা’ নামে গ্রন্থটি। লেখক হিশেবে যার নাম পাওয়া যায় তিনি কামিনীকুমার ভট্টাচার্য।   যেখানে দেশাত্মবোধক কিছু কবিতা জায়গা করে নেয়। গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয় ১৯১১ সালের ৭ই মার্চ। এখানে উল্লেখ করে নিতে পারি যে, তৎকালীন সময়ে বেশীর ভাগ গ্রন্থ প্রকাশিত হত কলকাতা থেকে। ১৯১০ সালের ৮ই আগস্ট,  গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে নিষিদ্ধ হয় সৈয়দ মহম্মাদ ইসমাইল সিরাজীর লেখা ‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থটি। কলকাতার নব্যভারত প্রেস থেকে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশক হিশেবে নাম পাওয়া যায় ভূতনাথ পালিত।  সৈয়দ মহম্মাদ ইসমাইল সিরাজীর ‘অনল প্রবাহ’ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্নি ঝড়াতে অনেকটা সক্ষম হয়। সেই সময় উক্ত গ্রন্থটি বাঙালী মহলে অনেকটা আলোড়ন তোলে। তৎকালীন সময়ে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর উদ্দেশ্যে সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন, ‘কবি হিসাবে আমাকে অনল প্রবাহের লেখক যে আদর দেখিয়েছিলেন তা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠতম পাওয়া। এমন  আদর সারা বাংলার আর কেউ আমাকে করেছে বলে আমি জানি না, তিনি সিরাজগঞ্জ  থেকে মানি অর্ডার করে আমাকে দশটি টাকা পাঠিয়েছিলেন এবং কুপনে লিখে দিয়েছিলেন-‘এই সামান্য দশটি টাকা আমার আন্তরিক স্নেহের প্রতীক স্বরূপ পাঠালাম। এই টাকাটা দিয়ে তুমি একটা কলম কিনে নিও। আমার কাছে এর বেশী এখন নেই। যদি বেশী থাকতো তোমাকে আরও বেশী পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। তা হলো না।’  নিষিদ্ধ তালিকায় আবার আমরা দেখতে পাই, ১৯২১ সালে ‘খিলাফৎ কবিতা’ ও ‘মহাত্ম গান্ধীর কবিতা’ শিরোনামের দু’টি গ্রন্থ। ‘খিলাফৎ কবিতা’ সিলেট থেকে প্রকাশিত। ‘খিলাফৎ কবিতা’র লেখক হিশেবে নাম পাওয়া যায় মুন্সী আবদুল হান্নান চৌধুরী। বাজেয়াপ্তকারীর নাম হিশেবে পাওয়া যায় অসম সরকার। ‘মহাত্ম গান্ধীর কবিতা’-গ্রন্থের লেখক চন্দ্রনাথ দাস। আসাম সরকার কর্তিক নিষিদ্ধ হয়। প্রকাশিত স্থান হিশেবে পাওয়া যায় শিলচর। ১৯২২ সালে দু’টি গানের বই নিষিদ্ধ হয়। বই দু’টি হ’লো, ‘বন্দেমাতরাম’ ও ‘গানের তুফান’।  ‘বন্দেমাতরাম’ বইটি  দেশাত্মবোধক  বাংলা গানের একটি উৎকৃষ্ট সংকলন। ললিতমোহন সিংহ কর্তিক বইগুলো প্রকাশিত হয়। ‘গানের তুফান’ বইয়ের লেখক হিশেবে নাম পাওয়া যায় মৌলভী হাফিজুর রহমানের। বইটি সিলেট থেকে নিষিদ্ধ হয়। ১৯২৩ সালে, মোবারক আলির ‘কাইয়ের ঘাট হাঙ্গামার কবিতা’ শিরোনামে একটি বই নিষিদ্ধ হয়। বইটির প্রকাশ স্থান হিশেবে নাম পাওয়া যায় সেই সিলেটকেই। ঠিক তার পরের বছর, ১৯২৪ সালে, কবি সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের ‘রক্তরেখা’ শিরোনামে একটি কবিতার বই নিষিদ্ধ হয়। কবিতার উক্ত বইটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে ‘আবাহন’ শিরোনামের একটি গানের বই নিষিদ্ধ হয়। ১২ই জানুয়ারির এক গেজেট ঘোষণার মধ্যে দিয়ে উক্ত বইটি নিষিদ্ধ হয়। সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল সংকলন হিশেবে বইটির খ্যাতি রয়েছে। তথ্য মতে জানা যায়, বইটি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। বই নিষিদ্ধের পালা যেন কোন ভাবেই থামছে না। একের পর এক-একটি বই নিষিদ্ধ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘ডমরু’ কাব্যগ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয় ১৯৩০ সালের ৬ই অক্টোবরে। ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪-এ, ধারা মতে উক্ত গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। ঠিক তার পরের বছর, ১৯৩১ সালে কালিকিংকর সেনগুপ্তের ‘মন্দিরের চাবি’ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধের তালিকায় অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকে নগেন্দ্রনাথ দাস। তাঁর নিষিদ্ধ হতে থাকে ‘দেশভক্ত’, ‘দীনেশের শেষ’, ‘ফাঁসি’, ‘রক্তপতাকা’ এবং ‘শোকসিন্ধু’ শিরোনামের গ্রন্থগুলো। ‘শোকসিন্ধু’ ১৯৩১ সালের ৯ই এপ্রিলে নিষিদ্ধ হয়। ‘দীনেশের শেষ’ গ্রন্থটি ১৯৩১ সালের ১৬ই জুলাই  নিষিদ্ধ হয়। । ‘দেশভক্ত’, ১৯৩১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর-এ, নিষিদ্ধ। ‘রক্তপতাকা’ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয় ১৯৩২ সালের ২১শে জানুয়ারি। ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২৪-এ, ধারা মতে উক্ত গ্রন্থগুলো নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ তালিকায় যুক্ত হতে থাকে তাঁর ‘হিজলির বন্দীশালা’ শিরোনামের আরও একটি ছোট গ্রন্থ। এখানে উল্লেখ্য করা যেতে পারে, তাঁর বইগুলো লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরী ও ভারতীয় অফিস লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রয়েছে। বিপ্লবী চেতনার সাথে সর্বদা যুক্ত ছিলেন নগেন্দ্রনাথ দাস। তাই কোন ভাবেই যেন নিষিদ্ধের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না তিনি। তাঁর লেখা দেশাত্মবোধক কবিতাগুলো তরুণদের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। শ্রীমত্তকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত ‘জাতীয় সঙ্গীত ও দেশের গান’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ ১৯৩২ সালে নিষিদ্ধ হয়। এটি একটি বাংলা জাতীয় সঙ্গীতের সংকলন। সেই একই বছর, ১৯৩২ সালে চারণ কবি মুকুন্দরাম দাসের ‘কর্মক্ষেত্রের গান’ ও ‘পথের গান’ শিরোনামের দুটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়। ১৯৩২ সালে, ধরণীধর  প্রধানের ‘আবেগ সঙ্গীত’ শিরোনামের একটি গানের বই নিষিদ্ধ হয়। অনন্তকুমার সেনগুপ্তের ‘স্বরাজ সঙ্গীত’ শিরোনামের গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয় ১৯৩৩ সালের ৯ই জানুয়ারিতে। আর প্রতাপচন্দ্র মাইতি রচিত ‘স্বরাজ সঙ্গীত’ নিষিদ্ধ হয় ১৯৩১ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বরে।  


অন্য অনেকের মতো, সেই নিষিদ্ধ তালিকায় আরও একজন যুক্ত হন। তিনি অন্য কেউ নন, আমাদের প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে নজরুল যেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে রূপান্তর হন। বাংলা সাহিত্যে তিনি যেন দেখা দেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা রূপে। সেই নিষিদ্ধের ছোঁয়া যেন তাঁর শরীরে অনেকটা আটকে থাকে। এক প্রতিভাবান কবি যেন মিশে যাচ্ছেন সেই নিষিদ্ধের তালিকায়। যে তালিকায় পাওয়া যাবে আরও অনেকের নাম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর একক পদচারণ যেন আনেকটা সাহসী পরিচয় প্রদান করে। নজরুল কেবল মাত্র তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই সমস্ত বাঙ্গালীকে অনুপ্রাণিত করেননি; বরং জাতীয় আন্দোলনের ঘটনার সাথে মিশে ছিলেন খুব গভীর ভাবে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর, ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’তে প্রায় সমসময়ে প্রকাশিত হল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। সেদিনের ঘটনার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় নজরুল বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের লেখায়। তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহী’র রচনাকাল ১৩২৮ সালের পৌষ মাসের প্রথমে। অনেকের মতে এটা আবার নাকি দেখা দেয় কার্ত্তিক মাসে। কিন্তু ব্যাপারটি সুস্পষ্ট এই যে, ‘মোসলেম ভারত’ নিয়মিত প্রতিমাসে প্রকাশিত হত না। ঐ কার্তিকের সংখ্যাটি বেরিয়েছিল পৌষের শেষের দিকে। বাংলাদেশ ও কলকাতার পাঠক প্রথম তার স্বাদ পেল ‘বিজলী’তে। ‘বিদ্রোহী’ সেদিন যে আলোড়ন তুলেছিল তার কথা অনেকে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। এ-সম্পর্কে, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি একসঙ্গে ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’তে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলের খ্যাতিতে বাঙ্গালী সমাজ একেবারে টগবগ করে উঠল। তরুণ সমাজ ত ‘বিদ্রোহী’র ভাষায় বাক্যলাপ শুরু করে দিল। মুখে- মুখে রটে গেল নজরুলের কিংবদন্তীর কথা। নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় সেটি ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে বাংলা সরকার ফৌজদারী বিধির ৯৯-এ, ধারা অনুসারে বইটি নিষিদ্ধ করে। ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধের ২০ বছর পরেও বইটি সম্পর্কে সরকারি মহলে অনেক শঙ্কা ছিল। ব্রিটিশ সরকারের আমলাতন্তের কাছে ‘যুগবাণী’-যে, কত বিপদজনক বই ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।