‘আব্বার খোলায় ধান মায়ের কোলেতে আমি একই দিনে একই সঙ্গে  এসেছিলাম। আড়িয়ল বিল থেকে সোনার গুঁড়োর মতো বোরোধান এলো, ঘোড়ার পিঠের থেকে ছালার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়লো লেপানো উঠোনে, তখনি আতুর ঘরের থেকে দাদি চিৎকার
ক’রে উঠলেন, রাশু, রাশু, তোর ঘরে এইবার সোনার চানই আইছে।’


হুমায়ুন আজাদ, তাঁর এ কবিতাটির নাম রাখেন ‘হুমায়ুন আজাদ’। তিনি নির্বাচন করেন এ রকম একটি নাম। যা কবিতা থেকে ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদকে বেশি প্রকাশ ক’রে। কবিতাটি দেখা দেয় আত্মস্মৃতিচারণ হ’য়ে; যার মাঝে আমরা পাবো একজন মানুষকে, একজন সৌন্দর্যময় কবিকে, সর্বোপরি একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে। যেহেতু কবি মাত্রই নিঃসঙ্গ। দীর্ঘ এ কবিতাটি শুধু ব্যক্তি স্মৃতিচারণ নয়; বরং দেখা দেয় বাঙলাদেশের বেড়ে উঠার ইতিহাস। যেখানে আমরা পাবো ‘বাঙলাদেশ’ এবং ‘পাকিস্তান’ শিরোনামের নামগুলো। যে নামগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় একটি স্বাধীন বাঙলাদেশের। কবিতাটির মধ্যে তাই বলেনঃ
                                
‘আমি পাকিস্তানের সমান বয়সী। স্বাধীনতায় আমার কোনো দরকার ছিল না ১৯৫৭ পর্যন্ত। ১৯৫৮- তে যখন  সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, হাফপ্যান্ট ছাড়িছাড়ি করি, হঠাৎ একলা দুপুরে আমার স্বাধীনতা দরকার হয়। চিৎকার করে বলি, স্বাধীনতা চাই।  
ঘাটে মাঠে সারা বঙ্গে খুঁজে দেখি স্বাধীনতা নাই।’    


কবি একই সঙ্গে তু’লে ধরেন বেড়ে উঠার সাথে যাঁদের সঙ্গে কবির ছিল নিবিড় সম্পর্ক। এ কবিতাটি একটি পরিপূর্ণ কবিতা হলেও বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয় কবির এক সৌন্দর্যময় উজ্জ্বল স্মৃতির কথা। যা বার বার রোদনের স্মৃতি হ’য়ে ফিরে আসে কবির আঁখিকোণে। করুন কষ্টের দাগ ও গেঁথে থাকে কবিতাটি জুড়ে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের এক চিহ্ন ফুটে উঠে কবিতাটিতে। কবিতাটির মধ্যে আবার আমরা দেখতে পাইঃ  
                        
‘চার পাশে ডানে বাঁয়ে ভাঙছেই কেবল।
আমার বাল্যকালে আমি কিছু গড়তে দেখি নি
না সড়ক না ব্রিজ না কুটির না ইস্কুল
চারি দিকে ভাঙছেই কেবল
মাত্র একটি গড়া আমার বাল্যকাল দেখতে পেয়েছে
সে স্মৃতি রক্তের দাগের মতো লেগে আছে আমার ভেতরে জেলাবোর্ডের  ভাঙা সড়ক দিয়ে একটি প্রচণ্ড স্রোত গেলো মানুষের ছোট্ট আমি বুঝতে পারি নি  কে নো মানুষেরা এমন প্রচণ্ড নদী এমন লেলিহান আগুন হয়ে ওঠে সেই আমার জীবনের আদি স্রোত জীবনের প্রথম আগুন তারা রাষ্ট্র ভাষা বাঙলা চেয়ে ভাঙা সড়ক দিয়ে কোন দিকে গেলো ? আমি তা বুঝতে পারি নি। আজ বুঝি তারা গিয়েছিল আমারই
ভবিষ্যতের  দিকে।’


এক প্রকার স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই কবি এগিয়ে জান তাঁর অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। যেখানে গেঁথে থাকে স্বপ্নের পর স্বপ্ন। যে স্বপ্ন কোনো একদিন সত্যি হ’য়ে দেখা দেয় তাঁর-ই জীবনে। কবি, কবিতাটি যতোবার-ই  সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন; ততবার-ই যেনো ফিরে এসেছেন তাঁর স্মৃতিমাখা শৈশবের কাছে। যে শৈশবের দুঃখ গাঁথা কষ্টগুলো জমা রয়েছে কবির মনের অন্তরালে। যা উকি মেরে দেখা দেয় গাঢ় আর গভীর হ’য়ে। নিজের নামের কবিতাটিতে শুধু নিজের নাম প্রকাশ ক’রে স্থির থাকেননি; সেই সাথে তু’লে ধরেন চেতনার সর্বদিকটি, যেখানে নিবিড় ভাবে বেড়ে উঠে ‘বাঙলাদেশ’ নামের ভূখণ্ডটি। যে নামটি একত্রীভূত হ’য়ে  গেঁথে থাকে ‘হুমায়ুন আজাদ’-এর নামের সাথে। দীর্ঘ এ কবিতাটিতে ফুটে উঠে শৈশব স্মৃতি, কৈশোরের উজ্জ্বল স্বপ্ন, ভাষা, স্বাধীনতা, গাঢ় দুঃখ এবং গভীর প্রেম। অতীতে ফেলে আসা সেই সব স্মৃতি; যা আজো বেঁচে আছে তাঁর অশ্রুময় আঁখিকোণে। করুন প্রেমের জন্য আবার দেখা দেয় সেই অজানা স্বপ্ন; যে স্বপ্ন মিশে থাকে আলো-আঁধারের এক অনুভূতিময় সৌন্দর্যে। তাই প্রেমের জন্য আবার যখন বলে উঠেনঃ


‘কিন্তু প্রেম, আজো স্বীকার করি, আমার নিকট বড়ো বেশি ছিলো। বিশ্বাস, কবিতা পড়তে ভালোলাগা, ছন্দ মেলানো, প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান পাওয়া,
তার চেয়ে বড়ো বেশি ছিলো প্রেম, বড়ো বেশি
ছিলে তুমি, আমার বিষাক্ত প্রেম, ব্যর্থ ভালোবাসা।’


প্রেম, ব্যর্থতা আর ভালোবাসা দেখা দেয় কবির জীবনে করুন ভাবে। খুব অভাববোধ করেন সেই ভালোবাসার জন্য যা তিনি হারিয়েছেন জীবনের কোনো এক সময়ে। সেই ভালোবাসার বিষাদমাখা স্মৃতি কবিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাঁর ফেলে আসা অতীত জীবনে। কবিতার সাথে বিশ্বাসকেও নিয়ে আসেন ভালোবাসার রূপ দিয়ে। যা তাঁর–ই জীবনে দেখা দেয় জীবনের করুন সুর হ’য়ে। প্রেমকে মেনে নেন মনের গভীর থেকে; যা দেখা দেয় উজ্জ্বল আলোর উদ্ধার থেকে। যে ভালোবাসা জমা ছিল হৃদয়ে, তা কি আজও জীবিত আছে ? যার জন্য করুন অশ্রু জমা ছিল আঁখিকোণে ! তাই কবিতার মধ্যে এসে আবার আমরা শুনতে পাই সেই উক্তি ‘আজো কি তা আছে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ?’ তার কোনো উত্তর আমরা আর জানতে পারি না। এগিয়েছেন জীবনের সামনের দিকে; ফেলে এসেছেন সৌন্দর্যময় অতীতকে, যার জন্য আজো বুক হা-হা কার ক’রে উঠে। একই কবিতায় আবার যখন শুনতে পাই ‘চশমার কাচ ভারি হচ্ছে দিন দিন’ এর মতো পঙক্তি। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তিনি আজ আর ভালোবাসায় কাতরতাবোধ করেন না; আবেগ আপ্লুত হ’য়ে পড়েন না প্রেম ও সৌন্দর্যে। সব কিছু পিছে ফেলে আবার সম্মুখীন হলেন কঠিন এক সময়ের, যা প্রকাশ পায় ২৫ মার্চ ১৯৭১ নামে। বিবর্ণ বাঙলাদেশের কথা মনে রেখে তার স্মৃতি অম্লান হ’য়ে গেঁথে রয় ছোটো হৃদয়ের মাঝে। তিনি  বেঁচে আছেন কালের এক অপরূপ বিবর্ণ চাঁদ হ’য়ে বা শ্রাবণ সন্ধ্যার জ্যোতির্ময় জ্যোৎস্না হ’য়ে। একই কবিতায় আবার শুনতে পাইঃ


‘যে কোনো কারণে মারা যেতে পারতাম। আমি বাঙালি,
বাঙলা পড়াই, ভাত খাই, প্রেমে পড়ি, ব্যর্থ হই, রাত্রে ঘুমাতে দেরি  হয়, আমি মানুষ, এর যে কোনো একটির জন্যে রাষ্ট্রদ্রোহী বিবেচনায় আমাকে নিয়ে যেতে পারতো ওরা বধ্যভূমিতে।’  
      
মরে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর কবিতায়। ওগুলো ছাড়াও তিনি করুন ভাবে উল্লেখ করেন ‘আমি মানুষ’। এটাও মারা যাওয়ার জন্য বড়ো একটা কারণ হ’তে পারে তা আমরা গভীর ভাবে উপলব্ধি করি। তিনি নেই; মারা গেছেন, হত্যা করা হয়েছে। তার অনেক দশক পরে। উল্লেখিত কোনো কারণের জন্য নয়; মুক্ত-চেতনাশীল ভাব প্রকাশের জন্য। হৃদয়ের বধ্যভূমিতে আজো জীবিত আছেন; আছেন স্বপ্ন ও কল্পনায়। আছেন আমার চেতনায় আমার সৌন্দর্যে; কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে।


                      হুমায়ুন আজাদ, তাঁর প্রথম কাব্যটি শেষ করেন অনাগত কোনো সন্তানের কথা মনে রেখে। যে আজো দেখা দেয়নি আঁখিজুড়ে। স্বাধীনতার জন্য এ যেনো করুন এক কণ্ঠস্বর। যা আমাদের মগজে গেঁথে রয়েছে কোনো এক দীর্ঘ সময় ব্যাপী। যে আমার ভাবনায় ও মননে ধরা দিবে; আমার সময়ে। তাই কবিতাটির শেষের দিকে বলেনঃ


‘আমার সন্তান আজো জন্মেনি। যদি জন্মে
সে কি জন্মেই পাবে স্বাধীনতা? আমার বাবার
স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছিল আমার জীবনে।
আমার স্বাধীনতা কী রকম হবে আমার সন্তানের জীবনে?  
নাকি তাকেও বলতে হবে আমার মতোই কোনো দিন,
‘এতো দিনে স্বাধীন হলাম।’
আমার সন্তান কি চাইবে জানি না। পরবর্তীরা সর্বদাই
অধিক সাহসী, তাদের চাহিদা অধিক।
আমি চাই আমার আলোক সত্য হোক তার মধ্যে
আমি শুধু চাইতে পারি তার মধ্যে সত্য হোক আমার জ্যোৎস্না।’


হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩: ১৩৭৯)–এর শেষ পঙক্তি ছিল এগুলো। যে পঙক্তির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘স্বাধীনতা’ নামের ভিতর দিয়ে আবেগ আপ্লুত অশ্রুমাখা ভালোবাসা। যে ভালোবাসা বুকের গভীরে লুকিয়ে ছিল কয়েক দশক ব্যাপী। তার বিস্তৃত প্রকাশ পেল যেনো এ পঙক্তির মধ্যে দিয়ে। অনাগত সন্তানের জন্য রেখে যাওয়া এ ভালোবাসা যেনো অম্লান রোদনের স্মৃতি হ’য়ে ভেসে উঠে ছোটো আঁখি কোণে। কবিতাটি অতিক্রম করেছে দীর্ঘ কয়েক দশক সময়। তাঁর সন্তানরা আজ বর্তমান। কণ্ঠ উচ্চারিত ক’রে বলতে কি পেরেছে ‘এতো দিনে স্বাধীন হলাম ?’ নিজের চেতনার ভাবনাবোধটি জাগ্রত ক’রে দিতে চান আগামী দিনের অনাগতদের হাতে। হুমায়ুন আজাদ; কবিতাটির শেষের দু’পঙক্তিতে ‘সত্য’ শব্দটি উচ্চারণ করেন দু’বার। আমি চাই আমার আলোক ‘সত্য’ হোক তার মধ্যে এবং আমি শুধু চাইতে পারি তার মধ্যে ‘সত্য’ হোক আমার জ্যোৎস্না। যে শব্দটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন তাঁর জীবনে বহু পূর্বে। সত্য শব্দটি উচ্চারিত হওয়া মাত্রই যেনো মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সেই সত্যই যেনো আবার ফিরে আসে এখানে অন্যরূপে, অন্য কবিতায়। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় পাওয়া যাবে অপরূপ সৌন্দর্য, ইন্দ্রিয়ের অনন্ত আলোড়ন, ধ্যানের গভীর উৎসারণ, জীবনের আদিম সুখ, রূপক-প্রতীক-চিত্রকল্পের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়; যা বাঙলা ভাষার পরিস্রুত মিলন। যার কবিতায় আবেগ এবং প্রেমময় ভালোবাসা ফিরে এসেছে বার বার এবং বহুবার। কখনো সেই ভালোবাসায় প্রকাশ পেয়েছে সফলতা; কখনো তা আবার চরম ভাবে পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়। যে ব্যর্থতায় মিলেছে হিম, জ্যোৎস্না, শিশির, এবং জ্যোতির্ময় এর মতো অবাধ শব্দমালা। যার ব্যাপক বিস্তার রয়েছে সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে। স্বাধীনতা শব্দটির দ্বারা যার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল তিনি হুমায়ুন আজাদ। সকল সৌন্দর্যের মধ্যে থেকেও করুন সুরে বেজে উঠেছে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি। যে শব্দটিকে হৃদয়ের গভীরে ধারণ ক’রে বেঁচে ছিলেন অন্যদের সময়ে; কিন্তু তাঁদের দেখানো পথে নয়, নিজের রচিত সৌন্দর্যের মাঝে; স্নিগ্ধ ভালবাসায়।