জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তাঁকে বাংলা ভাষার ‘শুদ্ধতম’ কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে এসে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন, এবং ১৯৯৯ সালে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল তত দিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তিরিশে আধুনিক কবিদের মধ্যে ভাব ও ভাষার সার্থক ব্যবহারের জন্য, অনেকের কাছে তিনি-ই ঐ দশকের শ্রেষ্ঠ কবি বলে গণ্য হোন। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পুরোহিতপ্রতিম ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি শুধু আধুনিক বাংলা কবিতার নয়; চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের তথা কবিতার ইতিহাসেরও একজন অন্যতম কবি বলে বিবেচিত হোন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০) ‘বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জয়দেব-চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি-রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার যে আধুনিক বাংলায়ও সম্পূর্ণ অপচিত হয় নাই, জীবনানন্দের কবিতা সেই আশ্বাসের বাণীই বহন করে।’ জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলে যখন প্রবেশ করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন জ্যোতির্ময় আলোর মধ্যে গগণে। তবুও এর মধ্যে তাঁর কবিতা যে সুর আমাদের শোনায় তাতে অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আমরা বলতে পারি, জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসসচেতন কবি। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র গঠন প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর অনন্যতা বিষ্ময়কর। বিশেষতঃ কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবননান্দের নৈপুন্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা’ পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। জীবনবোধকে নাড়া দিয়েছে গভীর ভাবে। কবিতা কতটা উজ্জ্বল আর স্নিগ্ধময় হ’য়ে উঠতে পারে তা যেন আর বলার অপেক্ষা রাখে না তাঁর কবিতার দিকে তাকালে। আমরা ফিরে যাই সেই কবিতার কাছে, যে কবিতা আমাদের দৃষ্টির সীমানায় গেঁথে থাকে আপন মহিমায় ভোরের আলোর মতো। আবার এটাও আমাদের মনে রাখতে হয়; রবীন্দ্র-উত্তরকালে জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। জীবনানন্দ দাশের বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে ছিল গভীর উপলব্ধি। তাই অনেক চেনা জিনিসও তিনি কবিতায় তুলে এনে তাকে দিয়েছেন অনন্যতা। যা আমরা দেখেছি তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে। সেই প্রজ্বলিত সৌন্দর্য আমাদের চোখকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চিন্তাস্রোতের প্রবাহিত ধারা এতো গভীর, বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় যে অন্য অনেক কবি থেকে তাঁকে পৃথক করে নিতে আমরা বাধ্য হই।


তিরিশের পরের কোন কবি যদি ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, প্রেম-প্রকৃতি কাছে ফিরে যায়, বাস্তব-পরাবাস্তব, চেতন-অবচেতন, প্রতীক-উপমা কিংবা শব্দের সৌন্দর্যের বিস্তার ঘটায় যার সন্নিবেশ আমরা দেখতে পাই জীবনানন্দ দাশের ভেতর। আপাতদৃষ্টিতে জীবনানন্দের মনোভঙ্গী সততই রোমান্টিকতায় উজ্জ্বল, স্মৃতিভারাতুর, অনুষঙ্গময়, নষ্টালজিয়া পরাক্রান্ত, প্রেম-সৌন্দর্য-প্রকৃতি ও প্রাতিম্বিকতায় নিবিড় নান্দনিক। তাঁকে কখনো মনে হয় কীটস বা ইয়েটসের মতো স্বপ্নচারী, রূপকথা-অনুরাগী, প্রেম ও সুন্দরের সঙ্গসুখ উপভোগী। যেন এ যুগের সবচেয়ে ধ্যানী কবি তিনি। আধুনিক মানুষের ট্র্যাজেডি যেন সবচেয়ে বেশি নির্মম রূপ নিয়ে ধরা পড়েছে তাঁরই কবিতায়। সে অর্থে তিনি এই উদভ্রান্ত, বিশৃঙ্খলা, বিমুঢ়, আকাল-আক্রান্ত কালের সবচেয়ে আস্থাহীন, অনাশ্রিত কবি। কিন্তু তাঁর শত স্বপ্নবিলাসী, মগ্ন চৈতনিক ভাবধারা যেন কবিতার বিন্যাসে অনুষঙ্গ হয়ে ফুটে উঠে। রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩৭ সালে কোন এক চিঠিতে, জীবনানন্দ  দাশের কবিতা সম্পর্কে বলেন, ‘তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে, রবীন্দ্রনাথের এ মন্তব্য আজও অটল রয়েছে। আবার অপর পক্ষে, জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর সেই স্মৃতিময় কথাগুলো আমরা ভুলিনি। বুদ্ধদেব বসু, তাঁর ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’ শিরোনামে লেখাতে বলেন, ‘কিছুকাল পূর্বে জীবনানন্দ দাশগুপ্ত স্বাক্ষরিত ‘নীলিমা’ নামে একটি কবিতা ‘কল্লোলে’ আমরা লক্ষ করেছিলাম; কবিতাটিতে এমন একটি সুর ছিল যার জন্য লেখকের নাম ভুলতে পারিনি। ‘প্রগতি’ যখন বেরোলো, আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এই লেখককে আমন্ত্রণ জানালাম, তিনিও তার উত্তর দিলেন উষ্ণ, অকৃপণ প্রাচুর্যে। কী আনন্দ আমাদের, তাঁর কবিতা যখন একটির পর একটি পৌঁছতে লাগলো, যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম-এক সন্ধ্যা, ধূসর, আলোছায়ার অদ্ভুত সম্পাতে রহস্যময়, স্পর্শগন্ধময়, অতি সুক্ষ্ম ইন্দ্রিয়চেতন জগৎ-যেখানে পতঙ্গের নিশ্বাসপতনের শব্দটুকুও শোনা যায়, মাছের পাখনার ক্ষীণতম স্পন্দনে কল্পনার গভীর জল আন্দোলিত হ’য়ে ওঠে। এই চরিত্রবান নতুন কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে ধন্য হলাম আমরা।'  


জীবনানন্দ দাশকে আজ আমরা যতটা চিনি, তার প্রথম পরিচয়টি আমাদের সাথে করিয়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশের চেয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রায় বছর দশেকের কনিষ্ঠ হলেও দুজনই তিরিশের দশকের শক্তিশালী কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তবে বয়সের বিস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসুর কবিখ্যাতি বাংলা কবিতার পাঠকদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কথা আজ সত্যিই গভীরভাবে ভাবতে হয় যে, বুদ্ধদেব বসু খুব বেশী আপন করে নিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশকে।  স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন সমকালীন কবিদের প্রতি আশার বাণী বর্ষণ করে চলছেন, তখনও জীবনানন্দ দাশের জন্য তা অবারিত ছিল না। ভালো কবিতা লেখা যেমন একটা ক্ষমতার পরিচায়ক, তেমনি ভালো কবিতা পাঠের রুচি তৈরিও সাহিত্যে একটি ঘটনা। জীবনানন্দ যদি সত্যিই ভালো কবিতা লিখে থাকতেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা কাব্যপাঠককে আকৃষ্ট করতে পারল না কেন? এই প্রশ্নটির মধ্যেই নিহিত আছে বুদ্ধদেব বসুর গভীর ভাবনা। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের পরপরই বুদ্ধদেব বসু একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা লিখে এই কবিকে পাঠ করার জন্য পাঠককে রীতিমতো জবরদস্তি করতে থাকেন। তাঁর মতে, এমন লেখা বাংলা কবিতায় এর আগে কখনো দেখা যায়নি; আর এখানেই বুদ্ধদেব বসুর মহত্ত্বের জুরি মেলা ভার। বুদ্ধদেব ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত আত্মমুগ্ধ একজন লেখক, যিনি সর্বদা জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিষয়-শৈলীর মৌলিকত্ব নিয়ে অজস্র লেখা প্রকাশ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু সারাজীবন তাঁর পূর্বসূরি রবীন্দ্র-নজরুলের মতো সাহিত্যে সম্ভাবনাময় সবকিছুকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।


বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশকে ‘প্রকৃতির কবি’ বলেই উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ওর্ডসওয়ার্থ ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রকৃতির বিপুল সম্ভার সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশকে সত্যিকার অর্থে, ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁর আলোচনায়, জীবনানন্দ দাশকে গভীর থেকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি তখনও তাঁর নামটি অপরিচিতির আবরণে ঢাকা ছিল যে, তাঁর নামটি পর্যন্ত অধিকাংশ লোক শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে পারতেন না, শ্রীমান বসুর ভাষ্যানুসারে লোকে বলতেন, ‘জীবানন্দ’। যদিও বুদ্ধদেব এটা উল্লেখ করতে ভোলেননি, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পড়লে অনেকেরই তরুণ ইয়েটস কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলিয়টকে মনে পড়তে পারে; তবু তিনি যা করেছেন তা বাংলা কবিতার জন্য সম্পূর্ণ নতুন। তাঁর বিষয়-আঙ্গিক-ভাষা পরিবেশন পূর্ববর্তী সবার চেয়ে আলাদা; এমনকি দুরূহ ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের থেকেও তিনি আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। বুদ্ধদেব বসুর পর্যবেক্ষণ হল, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র ছন্দটিকে তিনি অবলম্বন করেছেন বটে কিন্তু তার চলনের ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। অথচ মাত্র বছর আটেক আগে এই কবিই তাঁর পূর্বসূরিদের পথ ধরে কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের স্বভাব এবং তাঁর কাব্যের নতুনত্ব দেখে বুদ্ধদেব বসু এ আশঙ্কা করতেও ভোলেননি যে, তিনি বাঙালি কাব্য সমাজে অপরিচিত থেকে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কারণ থাকবে না। কিন্তু সে পথের কাঁটা বুদ্ধদেব বসু কিছুটা দূর করে দিয়েছিলেন এই স্বীকৃতি তাকে দিতেই হবে। ‘বনলতা সেন’ লেখার ফলে জীবনানন্দ দাশকে সাধারণ কাব্যপাঠকরা প্রেমের কবি হিসেবে উল্লেখ করলেও বুদ্ধদেব বসু টের পেয়েছিলেন, প্রেমের কবিতা লেখা এই কবির ধাতে নেই; দু-একটা চরণ কখনো নর-নারীর প্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে ঝলসে উঠলেও পরক্ষণেই জীবনের গহীন অন্ধকারে তা হারিয়ে গেছে। অনুমান করা হয় যে, জীবনানন্দ দাশের কাব্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে চিত্রকল্পময়তার অনুযোগ তুলেছিলেন, সেটিও মনে হয় বুদ্ধদেব বসু থেকে ধার করা; কারণ বুদ্ধদেব বসু ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র পরপরই বলেন, ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যে দেখা যায় যে চিত্ররচনার অজস্রতা, তার বিশেষত্বও উল্লেখযোগ্য। যত উপমায়, যত ইঙ্গিতে তিনি কল্পনাকে প্রকাশ করেন, সেগুলো ভাবাত্মক নয়, রূপাত্মক; চিন্তাপ্রসূত নয়, অনুভূতিপ্রসূত।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতার কৌশল নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, এই কবির কান অত্যন্ত সজাগ। ছন্দকে ইচ্ছেমতো বেকিয়ে-চুরিয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। যেখানে বাধা পেয়েছেন সেখানে বাধাটাই যেন কবির অভিপ্রেত। ইংরেজি শব্দগুলোকেও তিনি এমনভাবে বাংলার সঙ্গে মিশেল দিয়েছেন, যাতে মনে হয় এই শব্দগুলো যেন এই ধরনের সম্পর্কের জন্য অপেক্ষা করেছিল। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য এটি দেখাতে ভোলেননি যে, কোথায় তিনি শেলি, কীটস, সুইনবার্গ, এলিয়ট বা ইয়েটসের শরণাপন্ন হয়েছেন। তবে তিনি একবারও বলেননি, এসব গ্রহণ ও আত্তীকরণ বাংলা কবিতার জন্য কিংবা জীবনানন্দ দাশের জন্য মন্দ হয়েছে; বরং এটি যে কবির জন্য দুর্বার ক্ষমতার প্রশ্ন এটিই স্বীকার করেছেন। কারণ তিরিশের প্রায় সব কবিই ইংরেজি সাহিত্য ভালো করে পাঠ করেছেন বলে প্রমাণ মেলে; কিন্তু জীবনানন্দ দাশ যে ক্ষমতা ও নতুনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আর কারো জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। বনলতা সেন প্রকাশের পরও বুদ্ধদেব বসু ১৯৪৩ সালে তাকে নিয়ে একইভাবে আলোচনা করেন। এ সময়ে জীবনানন্দ দাশ যথেষ্ট পরিণত হলেও কবিখ্যাতি তাঁর জন্য খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি; ফলে বুদ্ধদেবের প্রচারের দায়িত্বটি তাঁর জন্য জরুরি ছিল এটি বলাই যায়। তিনি টের পেয়েছিলেন যে, তাঁর কবিতা পড়লে যেভাবে কানে লেগে থাকে সে অনুপাতে পাঠক তাঁকে তখন পর্যন্ত নিতে পারেননি; বরং কবিসমাজ ভেতরে ভেতরে তাঁর অনুকরণের লোভ সংবরণ করতে পারছেন না। বুদ্ধদেব বসুর মতে, তিরিশের দশকটি বাংলা কবিতা মূলত ঐতিহ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় অতিক্রম করছে; সেদিক দিয়ে জীবনানন্দ দাশ তখন পর্যন্ত কবিতার প্রতি অনুরক্ত রয়েছেন; যদিও বুদ্ধদেব বসু বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখেছেন, তবু এটি জীবনানন্দ দাশের জন্য এটি একটি শ্লেষাকারে উপস্থিত ছিল। জীবনানন্দ দাশ প্রয়াত হওয়ার পরপরই বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৫ সালে ‘জীবনানন্দ দাশের স্মরণে’ নামে একটি বড়সড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধে একজন কবি জীবনানন্দ দাশ ও মানুষ জীবনানন্দ দাশকে যেভাবে তিনি অঙ্কন করেছেন, তা আমাদের সবাইকে অবাক করে দেয়।

মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই জীবনানন্দ দাশ ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন। ১৯১৯ সালে তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম ‘বর্ষা আবাহন’। কবিতাটি ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তখন তিনি ‘শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত’ নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামে লিখতে শুরু করেন। ১৬ জুন ১৯২৫ সালে; দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ লোকান্তর হলে তিনি 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন; যা বঙ্গবাণী পত্রিকার ১৩৩২ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত ‘কল্লোল পত্রিকায়’ ১৯২৬ সালের ফাল্গুন সংখ্যায় তাঁর ‘নীলিমা’ শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার প্রবেশ ঘটে। জীবদ্দশায় তাঁর ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত ঝরাপালক শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রকৃত কবিত্বশক্তি ফুটে ওঠেনি, বরং এতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। তবে দ্রুত তিনি স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ‘ধূসর পান্ডুলিপি-তে’ তাঁর স্বকীয় কাব্যকৌশল পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ভুবনে তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। শেষের দিককার কবিতায় অর্থ নির্মলতার অভাব ছিল। সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। নিজ কবিতার অবমূল্যায়ন নিয়ে জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন। তিনি নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও কাব্য সংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। কবির জীবদ্দশায় তাঁর মাত্র ৭টি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’ (কবিতা ভবন সংস্করণ), ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘বনলতা সেন’ (সিগনেট প্রেস সংস্করণ) এবং ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। উক্ত কবিতাগ্রন্থগুলোতে ১৬২টি কবিতা গৃহীত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ গ্রন্থটি নিয়ে কবিতা পাওয়া যাবে ২৫০টির কাছাকাছি। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতায়’ অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২৫টি কবিতা। অন্যান্য কবিতাগুলো অগ্রন্থিত, কিন্তু প্রকাশিত। এখানে আমরা আরও স্পষ্ট দেখতে পাই যে; উক্ত কবিতাতে ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে পাওয়া যাবে ৬টি কবিতা। ‘বর্ষ-আবাহন’ প্রথম প্রকাশিত কবিতা এবং বুদ্ধদেব বসু বিবেচিত ‘দুদিকে ছড়িয়ে আছে’ সর্বশেষ কবিতা বলে বিবেচিত হয়। এমনকী ‘রূপসী বাংলার’ সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির প্রথম দিকে নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ যা তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত; এবং ‘রূপসী বাংলা’  প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে; যা ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ নামে প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় তাঁর একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এ ছাড়া ষাট-পঁয়ষট্টির বেশি খাতায় ‘লিটেরারি নোটস’ লিখেছিলেন যা আজও প্রকাশ হয়ে চলেছে। আধুনিক বাঙালি পাঠক মাত্রই আজ জানেন, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার একটি আবশ্যিক নাম। রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল দুই পক্ষের বিপুল বিরুদ্ধতা জীবনানন্দ দাশকে সহ্য করতে হয়েছিল। এ-আজ কিংবদন্তির  মতো সত্য। সেই দুই পক্ষই অবশেষে তাঁকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এখানেই জীবনানন্দের সার্থকতা। তাঁর কবিতার অপার বিজয়।  


জীবনানন্দের দাশের জন্মের ১২০ বছরের বেশি সময় আজ অতিক্রান্ত; এবং মৃত্যুর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি। ভাবতে অবাক লাগে, এতো সময় চলে যাওয়ার পরও তাঁর কবিতার জনপ্রিয়তার কোনো ঘাটতি হয়নি। যেন দিন-দিন তাঁর কবিতা আরও বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হয় যে, কবিতা হারানোর জিনিস নয়; তা সময়- কাল এবং যুগচেতনায় হৃদয়ের গভীরে গেঁথে থাকে আপন মহিমায়, শ্রদ্ধা আর নিবিড় ভালোবাসায়।