মৃণালিনী দেবী (১৮৭৪-১৯০২) যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীর বউ হ’য়ে এলেন ১৮৮৩ সালে; তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বাইশ বছর। আর মৃণালিনী দেবীর দশ। কোন কোন মতে; তখনও মৃণালিনী দেবীর বয়স দশ হয়নি। আবার অনেকে বলেন, বয়স এগারোর একটু বেশি ছাড়া কম নয়। জীবিত রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫)। মৃণালিনী দেবী থেকে এক বছরের ছোট ছিলেন হেমলতা দেবী (পরবর্তীকালে বড়দাদা, দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে, দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া স্ত্রী)। ঠাকুর বাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা‘রবীন্দ্রনাথের বিবাহ বাসর’ (সমকালীন/ বৈশাখ ১৩৬৪) থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবের শেষ সামাজিক কাজ হওয়া সত্ত্বেও কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথের বিবাহে খুব একটা জাঁকজমক আয়োজন ছিল না। তার অন্যতম একটি কারণ ছিল, ঐদিনই শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি; সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন। অনুমান করা হয় যে, এ কারণে অনুষ্ঠান অনেকটা ম্লান হ’য়ে আসে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নদী পথে ভ্রমণরত। হেমলতা দেবী আবার লেখেন, ‘ঘরের ছেলে নিতান্ত সাধারণ আয়োজনে ঘরোয়াভাবে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল। ধুমধামের সম্পর্ক ছিল না তার মধ্যে।’ হেমলতা দেবী; মৃণালিনী দেবী সমবয়সী হওয়াতে তাঁদের মধ্যে বেশ সখ্যতা গ’ড়ে উ’ঠে। মনের আদান প্রদান বিনিময় হ’য়ে উ’ঠে যেকোন বিষয়ের। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের তিন মাস পরে আর একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন তিনি, ‘বিবাহে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে জোড়াসাঁকোতে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় কলকাতা মিউজিয়ামে প্রদর্শনী খুলেছে নতুন। সেই প্রথম কলকাতা প্রদর্শনীর প্রচলন শুরু হয়। সেই প্রদর্শনীতে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে মৃণালিনী দেবী ও যাবেন। বাসন্তী রঙের জমিতে লাল ফিতের উপর জরির কাজ করা পাড় বসানো শাড়ি পরেছেন কাকিমা। তাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। কথায় বলে; বিয়ের জল মেয়েদের গায়ে পড়লে মেয়েরা সুন্দর হয়ে বেড়ে উঠে। সেই রোগা কাকিমা দিব্যি দোহারা হয়ে উঠেছেন তখন। রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে এসে জুটলেন সেই সময় সেখানে, হাতে একটা প্লেটে কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে খেতে খেতে। কাকিমাকে সুসজ্জিত বেশে দেখে দুষ্টুমি করে গান জুড়ে দিলেন; তাকে অপ্রস্তুত করবার জন্য; তিনি গেয়ে উঠলেন- ‘হৃদয় কাননে ফুল ফোঁটাও/ আধো নয়নে সখি, চাও চাও।’ দশ বছরের বালিকা বধূ মৃণালিনী দেবীর এই বাসন্তী রঙের বসনখানি রবীন্দ্র স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তাই কবি শেষ যৌবনের অকাল বসন্তের আষাঢ়ে ক্ষণিকায় সোজাসুজি লিখলেন, ‘বাসন্তী রং বসন খানি/ নেশার মতো  চক্ষে ধরে।’ রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই মৃণালিনী দেবীকে পাত্রীরূপে নির্বাচন করার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, এক পিরালীত্ব ছাড়া ঠাকুরপরিবার ও রায়চৌধুরী পরিবারের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। সামাজিক, আর্থিক, আধ্যাত্মিক কোনো দিক দিয়েই  দুই পরিবারের মধ্যে তুলনা হতে পারে না। তবুও বিবাহ সেখানেই হলো।’ বাস্তবিক পক্ষে, বিবাহকালে বাংলাদেশের তরুণ প্রতিভাবান এবং সুপুরুষ সাহিত্যিকের যথার্থ দোসর বা সহধর্মিণী হবার মতো যোগ্যতা মৃণালিনী দেবীর যে ছিল না তা অনস্বীকার্য। কিন্তু বিবাহের অনতিকাল পরেই রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ, সান্নিধ্য এবং অপার ভালোবাসার মাধ্যমেই তাকে হৃদয়ের কোণে জায়গা করে দিলেন। শুধু তাই নয়; পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১)-এর ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘বাড়ির ছোট বউ হলে কি হয়, জোড়াসাঁকো বাড়ির তিনিই প্রকৃত গৃহিণী ছিলেন।’ মার কাছে সকলেই ছুটে আসতেন তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে। সকলের প্রতি তাঁর ছিল সমদৃষ্টি। তিনি ছিলেন সকলের দুঃখে দুঃখী, সকলের সুখে সুখী। তাকে কখনও কর্তৃত্ব করতে হয়নি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ভালোবাসার মন দিয়ে সকলকে জয় করে নিয়েছিলেন। তার জন্য ছোটোরা যেমন তাকে ভালোবাসতো; বড়োরা তেমনি স্নেহ করতেন।’ [পিতৃস্মৃতিঃ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর]


শুধু গৃহিণীপনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না মৃণালিনী দেবীর জীবন। একদা গ্রামের পাঠশালার ছাত্রী ভবতারিণী জোড়াসাঁকোর ঠাকুর  পরিবারের বধূ মৃণালিনী যাতে শিক্ষা-দীক্ষায় বাড়ির অন্যান্য বধূদের সমকক্ষ হ’য়ে উ’ঠে তার জন্য যথাসাধ্য সাধনা করেছেন সকলে মিলে। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) আদেশে (১৮৮৪-৮৫) সালের দিকে ‘লরেটো হাউসে’ ইংরেজি শিক্ষার জন্য গমন করেন মৃণালিনী দেবী। পরবর্তী সময়ে, রবীন্দ্রনাথের একান্ত ইচ্ছায় (১৮৮৫-৮৬) সালের দিকে পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের নিকট সংস্কৃতি শিক্ষালাভ শুরু। হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন  ও বলেন্দ্রনাথের কাছে মৃণালিনী দেবীর সংস্কৃত অধ্যয়নের পরিচয় পাওয়া যায় শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত একটি ‘পায়োনিয়ারস একসারসাইজ’ বুক থেকে।ওই খাতায় মৃণালিনী দেবীর স্বহস্তে লিখিত লেখাগুলো তার নিদর্শন বহন করে আজও। প্রথম সাতটি রচনা মহাভারতের শান্তিপর্বের অনুবাদ। অষ্টম ও বাইশ সংখ্যক রচনাদ্বয় স্বামী রবীন্দ্রনাথের চিঠির অংশ বিশেষ।      


অনুবাদ-চর্চা, ভাষাশিক্ষা, সাহিত্যসম্ভোগের মধ্যে দিয়েই মৃণালিনী দেবী ঠাকুর পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে বেশি একটা সময় লাগেনি। যার চিত্র আমরা দেখতে পাই; ১৮৮৯-এর দিকে, রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে প্রথম মঞ্চাভিনয়ে ‘নারায়ণীর’ ভূমিকায় অনবদ্ধ তাঁর সার্থক অভিনয়; যা মুগ্ধ ক’রে ঠাকুর বাড়ির সকলকে। মৃণালিনী দেবীর জীবনে সেই প্রথম অভিনয়। কিন্তু তার স্বাভাবিক অভিনয় ক্ষমতা সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
অবনীন্দ্রনাথ ‘ঘরোয়া’য় লিখিয়াছেন, ‘থিয়েটারের অভিনেতা, অভিনেত্রীরা পার্কস্ট্রীটের বাড়ির অভিনয় দেখিয়া যায়, এবং কয়েকদিন পরে এমারেলডে যে অভিনয় হয় তাহাতে অভিনেত্রীরা ঠাকুরবাড়ির অভনয়ের ঢং আশ্চর্যরূপে অনুকরণ করিয়াছিল।’


কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী; তার মায়ের গল্পের বই পাঠরত চিত্রটি স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, ‘আর একটা ছবি মনে পড়ে। শান্তিনিকেতনের দোতলার গাড়িবারান্দার ছাঁদে একটা টেবিল লাম্প জ্বলছে। মার হাতে একটি ইংরেজি নভেল। তার থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিদিমাকে শোনাচ্ছেন। মার চোখ মুখ স্পষ্ট কিছু মনে নেই; শুধু একটি অবয়ব। গল্প শোনার লোভে বোধহয় তাঁদের গল্পের আসরে কখনো গিয়ে বসেছি। তাই বইটার একটি মেয়ের নাম কি করে যে মনের মধ্যে গেঁথে থেকে গিয়েছিল খুবই আশ্চর্য লাগে। আমার তখন ইস্টলিনের রোমান্সে আকৃষ্ট হবার বয়স নয়, তবু বোধ হয় মার গল্প বলার ধরণে তার কণ্ঠস্বর যে বেদনা ফুটে উঠত তাতে আমার তখনকার শিশুমনে একটা অজানা বেদনার ছাপ রেখে গিয়েছিল। তাই বারবারা’র-নামটা মনে ছিল।’      


এ-ক্ষেত্রে আবার মনে করতে পারি, স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে, মৃণালিনীর শিক্ষা ব্যবস্থা আয়োজন করার ঘটনা।                  
বিবাহের দু’মাস পরেই (৭ ফালগুণ, ১২৯০) চুঁচুড়া থেকে পিতা দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, ‘প্রাণাধিক রবি, ইংরেজি শিক্ষার জন্য ছোটবউকে ‘লরেটো স্কুলে’ পাঠাইয়া দিবে। ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রীদের সহিত একত্র না পড়িয়া তাহার স্বতন্ত্র শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত করিবে। তাহার স্কুলে যাইবার কাপড় ও স্কুলের মাসিক ১৫ টাকা সরকারি কোষাগার হইতে খরচ করিবে।’ পিতার এই নির্দেশনুসারে, অনতিবিলম্বে মৃণালিনী দেবীর জন্য বিদ্যালয়ের পরিচ্ছদ তৈরি হয়েছে প্রায় এক বছর (১৮৮৪-৮৫) সময় পর্যন্ত। মৃণালিনী দেবী ‘লরেটো স্কুলে’ ইংরেজি পড়েছেন। ঠিক একই চিত্র আমরা দেখতে পাই অমলা দাস ও বলেন্দ্রনাথের মা প্রফুল্লময়ী দেবীর লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘বলুর বিবাহে খুব ঘটা হয়েছিল। আমার ছোট জা মৃণালিনী  দেবীও সঙ্গে যোগ দিয়ে নানারকম ভাবে সাহায্য করেন। তিনি আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে লইয়া আমোদ–প্রমোদ করিতে ভালবাসিতেন।’ অমলা দাশ লিখেছেন, ‘সংসারে আমার বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। কাকিমার মতো বন্ধু আমার আর নাই, আর হবার সম্ভাবনাও নেই। কোন রকম মনে কষ্ট হলে, কোন অশান্তি হলে দৌড়ে যাবার আর দ্বিতীয় স্থান নেই। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কাকীমা ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী জোড়াসাঁকো বাড়িতে জন্মগ্রহণ করতেন না-তার ধারণা ছিল মাসোহারা এক হাজার টাকা দেবার হাত থেকে রেহাই পাবার মহর্ষি তার প্রাণনাশ করতে পারেন। তাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জল পর্যন্ত  গ্রহণে তার অনেক অনীহা ছিল। কিন্তু এ বাড়িতে মৃণালিনী তার অনেক প্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠল। মৃণালিনী দেবীর হাতের তৈরি মিষ্টি তিনি কখনও উপেক্ষা করতে পারেননি। ঊর্মিলা দেবী, মৃণালিনী দেবীকে প্রথম দেখার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘দিদি (অমলা দাশ) যার কাছে আমায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ’কাকীমা এটি আমার ছোট বোন’, যিনি আদর করে আমায় কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তোমার নাম কি ?’ তিনি নিতান্তই সাদাসিধে একখানা শাড়ী পরে বসেছিলেন। তাঁর গায়ে গয়নাও তেমন দেখা যায়নি। সাহস করে মুখের পানে চাইলাম, এই বুঝি কবি প্রিয়া; রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী। তিনি সে রকম তো দেখতে ভালো নয়। আবার একটু পরে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। এবার দেখলাম অপরূপ লাবণ্যেয় সমস্ত মুখখানা যেন মেখে রয়েছে। আর একটা মাতৃত্বের আভা যেন সমস্ত মুখখানায় উজ্জ্বল করছে। সেই মিষ্টি মুখখানা একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে হয়। সেই প্রথম দিন থেকেই তাঁর একান্ত অনুগত হয়ে পড়লাম। তার পর প্রায়ই সে বাড়ি গিয়েছি, দিদির সঙ্গে, থেকেছি কখনো কখনো। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম তিনি খুব অসাধারণ নারী। যে মাতৃত্বের আভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম তাই দিয়ে যেন শুধু নিজের পরিবার নয়; আত্মীয়-স্বজন, দাসী-চাকর সকলকেই আপন করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও মৃণালিনীর পরম ভক্ত ছিলেন। কিন্তু গর্ব বা ভীরুতার জন্য উল্টো কথা বলে মৃণালিনী দেবীর নিন্দে করতেন। সে কথা তিনি ক্ষণিকার ‘ভীরুতা’,‘ক্ষতিপূরণ’ , ‘উৎসর্গ ৩২ নং কবিতা’, ‘শেষ সপ্তক এক’ , ‘সানাই’-এর অদেয়, এবং ‘স্মরণে’র দ্বিতীয় কবিতায় লিখে গেছেন।’


মৃণালিনী দেবীর রান্নার হাত ছিল অসম্ভাব রকম। স্ত্রীকে নিত্যনতুন রান্নার ফরমায়েশ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। নানা রকম মিষ্টি তাঁর জন্য তৈরি করতেন মৃণালিনী। মৃণালিনী দেবীর  হাতের তৈরি দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিষ্টি আর চিড়ের পুলি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রিয় খাবার। একবার স্ত্রীকে দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ মানকচুর জিলিপিও বানিয়েছিলেন। কবির ফরমায়েশ শুনে প্রথমে হেসে খুব আপত্তি করেছিলেন মৃণালিনী দেবী। তার পর সত্যি সত্যি তিনি তা তৈরি করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথেকে। এই সব পারিবারিক আপ্যায়নে রবীন্দ্রনাথের সাথে মাঝে মধ্যেই যোগ দিতেন বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) আর নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়। তাঁরা সকলে মিলে কখনোও আবার রাত্রি যাপন করতেন পদ্মার বোটে। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় একবার পদ্মার বোটে নাটোরের মহারাজার জন্য স্ত্রীকে দিয়ে রান্না করালেন নতুন তালিকার একটি খাদ্য। রবীন্দ্রনাথের তালিকা করা সেই সব রান্নার উপকরণ আর পদ্ধতি মৃণালিনী লিখে রাখতেন একটি খাতায়। কন্যা মাধুরীলতার মৃত্যুর পর হারিয়ে যায় সেই খাতা। শান্তিনিকেতনের গৃহে মৃণালিনীর রান্নার করার বর্ণনা দিয়ে কন্যা মীরা দেবী লিখেছেন, ‘সরু একফালি বারান্দায় একটি তোলা উনুনে মোড়ায় বসে মা রান্না করছেন, তাঁর পিঠটা শুধু দেখা যাচ্ছে।’


রন্ধনপ্রিয়তা মেয়েদের সহজাত প্রবৃত্তি। এ-ব্যাপারে মৃণালিনী দেবীর নৈপুণ্যের কথা উল্লেখ করে হেমলতা দেবী বলেন,  ‘কবিপত্নীর রান্নার হাত ছিল চমৎকার। কবির জন্য প্রায়ই তিনি ঘরে নানা রকমের মিষ্টি তৈরি করতেন নিজের হাতে। একবার যারা তার হাতের চিঁড়ের পুলি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই খেয়েছেন তাঁরা আর সেই খাবারের স্বাদের কথা ভুলেননি। নাটোরের মহারাজা কবিপত্নীর হাতের তৈরি দইয়ের মালপোর প্রশংসা সর্বদা করতেন। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে একবার রবীন্দ্রনাথ–মৃণালিনী দেবী আর দ্বিপেন্দ্রনাথ-হেমলতা দেবীর যৌথ সংসার গড়ে উঠেছিল  শান্তিনিকেতনের কুঠিবাড়িতে। গৃহস্থালির ভাঁড় থাকতো কবিপত্নী মৃণালিনীর উপর। আর তাকে অন্যান্য কাজে সাহায্য করতেন হেমলতা দেবী। সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ, খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ, ব্যয়ের হিসেব রাখার ভার আমার স্বামী দ্বিপেন্দ্রনাথের। মৃণালিনীর রান্নার ও মিষ্টি তৈরির বিরাম ছিল না একদিনও। রবীন্দ্রনাথ থেকে থেকে মৃণালিনী দেবীকে বলতেন, নীচে বসে লিখতে লিখতে রোজ শুনি, চাই ঘি, চাই সুজি, চিনি চিড়ে ময়দা, মিষ্টি তৈরি হবে। জত চাচ্ছ তত পাচ্ছ। মজা হয়েছে খুব।’


বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আমোদ রবীন্দ্রনাথের স্বভাবে ছিল বড় কম না। একদিন প্রিয়বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে  মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ করলেন। যে কারণেই হোক তিনি যে কেবল পত্নীকে এ কথা বলিতে ভুলেছিলেন তা কিন্তু নয়; মধ্যাহ্নভোজকালে তার এ কথা স্মরণ হয় নাই। যথাকালে পরিবারবর্গের সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হল। ভোজনান্তে কবি নিজকক্ষে বিশ্রাম করছেন; এমন সময় বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে নিমন্ত্রিত প্রিয়নাথ কবির বিশ্রাম ভবনে প্রবেশ করলেন। দেখাবামাত্র আপনার বিষম ভ্রমের কথা কবির মনে হয়। বন্ধুকে অভ্যর্থনা করে বসাইয়া পত্নীকে নিমন্ত্রিত বন্ধুর উপস্থিতি জানালেন। স্থিরবুদ্ধি কবি পত্নী বন্ধুর সাথে কথা প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। রানাবান্না দ্রুত শেষ করে কিছু মিষ্টি আনলেন এবং ভোজনপাত্রে সাজিয়ে বন্ধুকে ভোজনগৃহে আসবার জন্য কবিকে সংবাদ দিলেন। বন্ধুর সাথে ভোজনগৃহে এসে কবি দেখলেন, পাত্র পূর্ণ, ভোজ্যর কোনো অংশেই ত্রুটি হয় নাই, সবই প্রস্তুত। দেখিয়াই কবি মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে  গৃহিণীপনার সার্থকতা বুঝতে পারলেন। বন্ধু ভোজন করলেন। নিপুণ গৃহিণীর বুদ্ধিমত্তায় গৃহীর নিমন্ত্রণ বিভ্রাট ধরা পড়লো  না, গৃহিণীর ইহাই দক্ষতা।    


বন্ধুসংখ্যা অল্প হলেও কবির গৃহে বন্ধুসমাগম অল্প হতো না। এই রূপ ভ্রান্তিমূলক নিমন্ত্রণ বিভ্রাট কবির এই একবারই মাত্র নহে; কবির ভাব বুঝিয়াই মৃণালিনী দেবী নানা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া রাখিতেন, বন্ধুসমাগমে আর খাদ্য বিভ্রাট ঘটিত না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কবির প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি প্রায়ই আসিতেন, সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে ‘কাকিমা’ বড় ক্ষিদে পেয়েছে’ এই আবদার করিতে করিতে উপরে উঠিয়া আসিতেন। কাকিমা  অপ্রস্তুত থাকিতেন না, সস্নেহ বাক্যে পাত্র ভরা খাদ্যে চিত্তরঞ্জনের চিত্তরঞ্জন  করিতেন। এই স্নেহের দৃশ্য  বড়োই মধুর ! কবি ও লোকেন্দ্রনাথ একই সময়ে বিলাতে মর্লি সাহেবের ছাত্র ছিলেন, সহপাঠিত্বে তাই উভয়ের  সৌহৃদ্য বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। কবির সঙ্গে দেখা করিতে লোকেন্দ্রনাথ প্রায়ই আসিতেন, সুহৃদ পত্নী যথোচিত সমাদরে আতিথ্য করিয়া তাঁহাকে আপ্যায়িত করিতেন। উদার স্বভাব পক্ষপাতহীন। বলেন্দ্রনাথ ও নীতীন্দ্রনাথ কাকিমার কাছে থাকিতেই ভালোবাসিতেন; তাঁহাদের প্রতি কাকিমারও পুত্রবৎ স্নেহ ছিল। অকৃত্রিম স্নেহ এমনই।  


রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে জোড়াসাঁকোর বাড়ির অভ্যন্তরে মা মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে বলেন, ‘বাবা ছিলেন তাঁর নিজের ঘরে লেখা পড়া নিয়ে। মা ছিলেন তাঁর ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসারের কাজে। সেই জন্য ছেলেবেলার কথা মনে করতে গেলে মায়ের কথাই বেশি মনে পড়ে। তাঁর নিজের পাঁচটি ছেলেমেয়ে; কিন্তু তাঁর সংসার ছিল সুবৃহৎ। বাড়ির ছোটবউ হলে কি হয়, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তিনিই গৃহিণী ছিলেন। বাড়ির অন্যান্য ব্যক্তির মতো বলুদাদা তাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই বলুদাদা সাহিত্যরসে মাতোয়ারা ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি যখন যে কোন বই পড়তে পারতেন। কাকীমাকে সেগুলি একবার পড়ে না শোনালে তাঁর তৃপ্তি হতো না। বলুদাদার কাছ থেকেই শুনে শুনে মায়ের এই তিন ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে বেশ ভালো করেই পরিচয় হয়েছিল। বলুদাদা আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন আমার বালক বয়সের  আদর্শ পুরুষ। সব সময়ই তাঁর পিছু পিছু ঘুরতাম। মা স্নান করিয়ে  দিতেন, কিন্তু প্রসাধন করতে যেতাম বলুদাদার কাছে। আমাদের তেতলার ঘরের সামনে মস্তবড় ছাদ। তার মাঝখানটা আবার উঁচু প্লাটফর্মের মতো-যেন বাড়ির খোলা বৈঠকখানা। সমস্তদিন ধরে এখানে চলত ছেলেমেয়েদের হুটোপাটি- তাদের শিশু কণ্ঠের কলরব মুখরিত করে রাখত চারপাশ। রোদ পড়ে গেলেই চাকররা জাজিম তাকিয়ে পেতে দিয়ে যেত মাঝখান উঁচু জায়গাটায়। মেয়েদের তখন সেখানে মজলিস বসত। চা-পান তখন চলন হয়নি। মা নানারকম  মিষ্টান্ন করতে পারতেন, ঘরে যেদিন যা তৈরি করতেন সকলকে তাই বিতরণ করতেন। গ্রীষ্মকালে সেই সঙ্গে থাকতো আমপোড়া শরবত।’


রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর; একই গ্রন্থে আবার বলেন, ‘মা ছিলেন স্নেহপরায়ণ ও মিষ্টি স্বভাবের। পরিবারের সবাই তাঁকে পছন্দ করত। তারা সুখে-দুঃখের কথা বলার জন্য মায়ের কাছে আসত। তিনি যেমন তাঁদের আনন্দ ভাগাভাগি করতেন তেমনি বিপদের সময় পরামর্শ দিতেন। সবার ওপর ছিল সমান স্নেহ, এক বলুদাদা (১৮৬৯-১৯২৯) ছাড়া। এ চাচাত ভাইটির প্রতি তাঁর বিশেষ মমতা ছিল। তিনি মাকে তাঁর লেখা পড়ে শোনাতেন, পড়ে শোনাতেন সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যকর্ম। মা’র কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু শুনতে শুনতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মহৎ রচনাগুলোর সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, আর সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে তাঁর খানিকটা জ্ঞানও জন্মেছিল।’      


১৮৯৮ সালের ৩ অগাস্ট, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে জোড়াসাঁকো থেকে শিলাইদহে বসবাসের জন্য চলে এলেন মৃণালিনী দেবী। সন্তানদের বিভিন্ন গৃহস্থ্য কর্মে হাতে দিয়েছিলেন মৃণালিনী। স্বাভাবিক নিয়মে রবিবার ছিল কাজের লোকদের ছুটির দিন। তাই ওইদিন বাড়ীর সকল কাজে হাত দিতেন সকলে মিলে। রবীন্দ্রনাথ যেমন উদার ছিলেন তাঁর প্রজাদের প্রতি, তেমনি কোনো মানুষ সাহার্য্য প্রার্থী হ’লে তাকে দু’হাতে সাহার্য্য করতেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথের অজ্ঞাতে, শিলাইদহে এক দরিদ্র পাঞ্জাবি মূলা সিংহকে মাসিক পনের টাকা বেতনে বাড়ীর দারোয়ানের কাজ দিলেন মৃণালিনী দেবী। ঠাকুর এস্টেটের স্বল্প বেতনভোগী নিয়োজিত কর্মীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে তিনি খুলে দিলেন অর্থের একটি নতুন দ্বার। মৃণালিনী দেবী, কুঠিবাড়িতেই নিজ হাতে করেছিলেন শাক-সবজির বাগান।