ইন্দ্রিরা দেবী লিখেছেন, ‘শান্তি নিকেতন থাকার সময় আশ্রমের ছেলেদের জন্য আগুন তাতে রেঁধে রেঁধেই কাকিমার শেষ অসুখের সুত্রাপাত হয়।’ অর্থকষ্ট, বাসস্থান জনিত অসুবিধা ছাড়াও  সেই সময় শান্তিনিকেতনে বিশুদ্ধ পানির অভাব চরম অভাব দেখা দেয়। তাতে কবি পরিবারের অনেকেই অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। এ মুহূর্তে; মৃণালিনী দেবী তাঁর গয়না বিক্রয় করে সমস্ত অর্থ  দিয়ে তাঁদের সুস্থ করে তুললেন। শান্তিনিকেতনে বাসকালীন সময়েই, ছাত্রদের দেখা-শুনা ও খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্বের ভার অনেকটা এসে পড়ে মৃণালিনী দেবীর উপর। শান্তিনিকেতনের জন্য এই কঠোর পরিশ্রমের ফলে অচিরেই মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হ’য়ে পড়েন। অসুখটা যখন খুব বাড়াবাড়ি তখন তাঁকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।


রোগ শয্যায় থেকে মৃণালিনী দেবী ছেলে সন্তানদের জন্য চিন্তায় নিমগ্ন। বিশেষ করে কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের জন্য, যেহেতু তাঁকে শান্তিনিকেতনে রেখে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় মৃণালিনী দেবী অনেকবার বলতেন, ‘আমাকে বলেন ঘুমাও, শমীকে রেখে এলেন বিদ্যালয়ে, আমি কি ঘুমাতে পারি তাঁকে ছেড়ে। বোঝেন না সেটা।’ তাঁদের শেষ সন্তান তখনও শিশু। মৃত্যুর ছায়া তাঁদের মনে ঘনিয়ে আসবে সেটা যেন রবীন্দ্রনাথ সইতে পারতেন না তাই শমীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনে রেখে এসেছিলেন। সন্তান স্নেহ কবির পরম ভালোবাসা। প্রথম সন্তান বেলাকে পিতা হয়েও, মায়ের স্নেহে  পালন করেছিলেন কবি। কারণ সে সময় মৃণালিনী দেবীর বয়স খুবই কম। কবি যেন ভরসা পেতেন না, তাই দুধ খাওয়ান, কাপড় পরানো সবই তিনি নিজের হাতে করতেন; [সংসারী রবীন্দ্রনাথ-হেমলতা দেবী]। মৃণালিনী দেবী যখন অসুস্থ, তখনও তাঁর পিসিমার সপত্নী  রাজলক্ষ্মী দেবী তাঁকে দেখতে আসেন। সপত্নী হলেও; মৃণালিনী দেবীর প্রতি আপন পিসিমার মতই অকৃত্রিম স্নেহ ছিল তাঁর। সেই সময়, মৃণালিনী দেবী তাঁকে ছেলে মেয়েদের ও সংসার দেখাশুনার ভার দিয়ে বলেছিলেন, ’পিসিমা, আমি শয্যাগতও, ছেলেমেয়েদের বড় কষ্ট হচ্ছে। তাঁদের দেখা শুনার কেউ নেই, তাঁদের ভার নিলে নিশ্চিন্ত হতে পারি।’ মৃত্যু পথযাত্রী সেই অনুরোধ রাজলক্ষ্মী দেবী অমান্য করতে পারেননি।মৃণালিনী দেবীর অবর্তমানে; তিনি মাতৃহারা সন্তানদের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।


মৃণালিনী দেবী প্রায় দু’মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। নার্স থাকা সত্ত্বেও কবি নিজের হাতেই তাঁর সেবা করেছেন। এ সম্পর্কে হেমলতা দেবী বলেন, ‘মৃত্যুশয্যায় কবি নিজের হাতেই তাঁর শুশ্রূষা করেছিলেন তার ছাপটি মুদ্রিত হয়ে রয়েছে পরিবারের সকলের মনে আজও। প্রায় দু’মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে স্ত্রীর শুশ্রূষার ভার কবি একদিনের জন্যেও দেননি। রবীন্দ্রনাথের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে ২৩ নভেম্বর, ১৯০২ সালে মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে বিদায় নিলেন কবি স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। মৃত্যুর আগের দিন; রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে, মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের বিছানার পাশে বসতে বলেন।  রথীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে বলেন, ‘তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগলো। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। আমাদের ভাই বোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরানো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারা রাত কেটে জাগল। ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, কোন প্রকার সারা শব্দ নেই। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ [পিতৃস্মৃতি-রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর]  সেই সময় শারীরিক অসুস্থতার জন্য হেমলতা দেবী কলকাতায় যেতে পারেননি। রাত্রে, তাঁর স্বামী এসে বললেন, ‘খুড়ির মৃত্যু হয়েছে। কাকামশাই একলা ছাদে চলে গেছেন; বারণ করেছেন কাউকে কাছে যেতে।’ সারারাত ছাদে  পায়চারি করে কাটান রবীন্দ্রনাথ। পরদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমবেদনা জানাবার জন্য বাড়িতে বিভিন্নজনের ভিড়। এ-সম্পর্কে রথীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাবা সকলের সঙ্গেই শান্তভাবে অসম্ভাব ধৈ্য্যের সঙ্গে কোঠা বলে গেলেন, কিন্তু কী কষ্টে যে আত্মসংবরণ করে তিনি ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারছিলুম। অবিরাম একমাস ধরে তিনি মার সেবা করেছেন, নার্স রাখতে দেননি, শ্রান্তিতে  শরীর মন ভেঙে পড়ার কথা। তার উপর আবার শোক। যখন সকলে চলে গেল, বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে মায়ের সর্বদা ব্যবহৃত চটিজুতো জোড়াটি আমার হাতে দিয়ে কেবলমাত্র বললেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।’ এই দু’টি কথা বলেই নীরবে তিনি তার ঘরে চলে গেলেন। মায়ের সেই চটি এখন রবীন্দ্রসদনে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে।


মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ  এই কনিষ্ঠ পুত্রবধূটিকে, [মৃণালিনী দেবীকে] অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাই তাঁর মৃত্যু সংবাদে বিচলিত হ’য়ে বলেছিলেন, ‘রবির জন্য আমি চিন্তা করি না। লেখাপড়া, নিজের রচনা নিয়ে সে দিন কাটাতে পারবে। ছোট ছেলে-মেয়েগুলির জন্যই দুঃখ হয়।’  মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর এগারো দিন পরে ১৮ই অগ্রহায়ণ, দীনেশ সেনকে নিজের শোকের কথা জানিয়ে কবি চিঠিতে বলেছেন, ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়েছেন, তাহা যদি নিরর্থক হয়, তবে এমন বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে। ইহা আমি মাথা নিচু করিয়া গ্রহণ করিলাম। যিনি আপনার জীবনের দ্বারা আমাকে নিয়ত সহায়বান করিয়া রাখিয়াছিলেন তিনি মৃত্যুর দ্বারাও আমার জীবনের অবশিষ্ট কালকে সার্থক করিবেন। তাহাঁর কল্যাণী স্মৃতি আমার সমস্ত কল্যাণকর্মের নিত্য সহায় হইয়া বলদান করিবেন।’ ১৩০৯ বঙ্গাব্দে, কবির ভবিয্যত জীবনের কর্মধারা ও কাব্যধারার ইঙ্গিত এই চিঠিখানিতেই পাওয়া যায়। মৃণালিনী দেবীর  মৃত্যুতে অমলা দাশ, ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন, ‘তিনি যে কি ছিলেন খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে না মিশলে কারু জানবার সম্বাবনা ছিল না। রবিকাকা কি রকম স্ত্রী পেয়েছিলেন, এতদিন তো অনেক বুঝেছেন এখন আরও পদে পদে বুঝবেন। একটি সংসার ছারখার করে কয়েকটি শিশুকে অসহায় মাতৃহীন করে কি মঙ্গল ইচ্ছা পূর্ণ হল জানি নে, তবু ভাবতে গেলে বলি তার মঙ্গল ইচ্ছা পূর্ণ হোক।’ আর এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘রবিকাকার চিঠি একখানা পেয়েছি। খুব সংক্ষেপে ঘটনাটা আমাকে জানিয়েছেন ও লিখেছেন  ছেলেদের মুখের দিকে চেয়ে অনেকবার আমাকে মনে করিয়েছিলেন। ছেলেদের কথা বিশেষ কিছুই লেখেননি। আমাকে মনে করে যে চিঠি লিখেছেন সেইটেই যথেষ্ট মনে করি। চিঠিখানি পড়ে তাঁর মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারলুম। কাকীমার সব রকম চেহারা মনে দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে- শেষ যে চেহারা দেখে এসেছি মনে হচ্ছে ফিরে গিয়ে ঠিক তেমনি দেখব, সেই জন্যই যেন মনটা ফিরে যাবার জন্য ছটফট করছে। তারপরে রবিকাকার একটা বিষণ্ণ মুখের সঙ্গে  সঙ্গে যা মনে পড়ে সেটা অসহ্য।...তোমাকে হয়ত অনেক কথা বলে বিরক্ত করছি। কাছে থাকলে কথায় যে আলোচনা হতে পারত, চিঠিতে সেইটে চালাচ্ছি।’ মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু কবির জীবনে কল্যাণের রূপ ধরে দেখা দিল-‘ তুমি ওগো কল্যাণরূপিণী মরণেরে করেছ মঙ্গল।’ রবীন্দ্রনাথ, ‘মংপুতে’ মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছেন, ‘যখন তিনি চলে গেলেন, তখন আমার এক মুহূর্ত অবসর ছিল না। শান্তিনিকেতন শুরু হয়েছে, হাতে পয়সা নেই, ঋণের পর ঋণ বোঝার মত চেপে রয়েছে, কাজের অন্ত নেই। তখন নিজের সুখদুঃখকে কেন্দ্র করে মনকে আবদ্ধ করবার অবসরই বা কোথায়।’    


মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর, পুত্র-কন্যাদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নিঃসঙ্গ হ’য়ে ফিরে আসেন, আর নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত রাখেন বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে। এই কাজের মধ্যে শোক বিহ্বল হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করলেন স্মরণ  কবিতার মাধ্যমেই। যে কবিতা, রবীন্দ্রনাথের আজন্ম প্রেয়সী এবং কবির জীবনের সমস্ত গভীর সত্যের আশ্রয় স্থান। তাই স্মরণের প্রতিটি কবিতা অত্যান্ত মূল্যবান হয়ে দেখা দেয়। মৃণালিনী দেবীর এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পোষাকে ব্যাপক পরিবর্তন আসে রবীন্দ্রনাথের। শেষ যৌবনের দিকে আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, বেশ পরিবর্তন রয়েছে পোশাক ও  রবীন্দ্রনাথের চুলের ছাঁটে। কবির প্রথম যৌবনে লেখা কড়ি ও কোমল  কাব্যেগ্রন্থে যেমন মৃত্যুশোকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কল্যাণকর্মও। সময় হিশেবে যেমন দেখতে পাই বসন্তের, শরৎ ও ফাল্গুন মাস। ঠিক একই ভাবে শেষ যৌবনের দিকে চোখ দিলে আমরা দেখতে পাইস্মরণ  কাব্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে মৃত্যুশোকের চিহ্ন। তাই অনন্য হয়ে ধরা দেয় এই কাব্যে। কারণ, স্মরণের পর থেকেই তিনি রূপ থেকেই অরূপের দিকে এগোতে থাকেন। ভাব থেকে রূপ, রূপ থেকে অরূপে, অর্থাৎ কবির ভাব কল্পনার অসম্পূর্ণ  মানসী থেকে কল্যাণী নারী রূপে ক্ষণিকার সৃষ্টি করলেন। যে সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের হৃদয় থেকেই বেজে উঠলো। মৃণালিনী দেবীর প্রেমের স্মৃতিই রবীন্দ্রনাথকেস্মরণ  পরবর্তীকালের জীবন ও কাব্যকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল, এবং ক্রমে এই রোম্যান্টিক প্রেমই বিশ্ব প্রেমে পরিণত হয়ে অসীমের দিকে প্রসারিত। তাই রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেন, ‘গৃহলক্ষ্মী দেখা দাও বিশ্বলক্ষ্মী হয়ে।’    


মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর, রবীন্দ্রনাথের শুধু যে পোষাকে পরিবর্তন এসেছিল তা কিন্তু নয়। খাদ্য তালিকায়ও নিয়ে আসেন ব্যাপক পরিবর্তন। নিরামিষ ভোজী হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। সময়ে সময়ে দেখা গেছে, খাদ্য ত্যাগ করে শুধু ছোলা ও মুগডাল ভেজান খেয়েও দিন কাটাচ্ছেন। এ সম্পর্কে হেমলতা দেবী লিখেছেন, ‘মাঝে মাঝে কার্যসূত্রে কবিকে পটিসরে যেতে হত। কবির শাশুড়ি ঠাকুরানী তখন নিজ গ্রাম যশোর জেলার অন্তর্গত ফুলতলা গ্রাম ছেড়ে পুত্রের কর্মস্থান পতিসরে বাস করতেন। তিনি স্বহস্তে মাছের ব্যঞ্জনাদি রান্না করে জামাতার পাতে দিলে কবি না বলতেন না। কন্যা নাই পাছে তিনি মনে কষ্ট পান ভেবে নিজের ইচ্ছা সেখানে কবি খর্ব করতেন। সঙ্গের ভৃত্য উমাচরণ ফিরে এসে আমাদের কাছে গল্প করত, ‘এখানে বাবু মশায় খাওয়া নিয়ে এত গোলমাল করেন, পতিসরে কিন্তু শাশুড়ি ঠাকরুন যা দেন তাই খান, একটি কথা বলেন না-শাশুড়ি কি না।’  
মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে মৃণালিনী দেবী বিদায় নিলেও রবীন্দ্রনাথের মন থেকে তিনি কখনো হারিয়ে যাননি। তিনি জীবিত অবস্থায় যেভাবে কবির জীবন ভরে রেখেছিলেন, ঠিক তেমনি দুঃখের সাথে হয়ে কল্যাণ কর্মের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরেও ঠিক সেই ভাবেই কবির জীবনকে পূর্ণ করে রেখেছিলেন [মংপুতে রবীন্দ্রনাথ]। তাই তিনি কর্মে ও ধ্যানে বিরাজমান ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাই আমরা দেখতে পাই, সাংসারিক জীবনের একান্ত নিঃসঙ্গ ও ভাবনালোকের মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ, অমলা দাশকে বলেছিলেন, ‘দেখো অমলা, মানুষ মোড়ে গেলেও যে একেবারে হারিয়ে যায়, সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। তিনি এতদিন আমাকে ছেড়ে গেছেন, কিন্তু যখনই আমি কোন একটা সমস্যায় পড়ি যেটা একা মীমাংসা করা আমার পক্ষে  সম্ভাব নয়, তিনি যেন এসে আমার সমস্যার সমাধান করে দেন। এবারেও আমি কঠিন সমস্যায় পড়েছিলুম, কিন্তু এখন আর আমার মনে কোন দ্বিধা নেই।’


মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর কয়েকমাস পরে অসুস্থ কন্যাকে নিয়ে কবি যখন আলমোড়ায় ছিলেন সেই সময় প্রিয়নাথ সেনকে চিঠিতে (৩০ মে, ১৯০৩) লিখলেন,’সংসারের তরুণীটি নানা প্রকার তুফানের উপর ভাসিয়ে দিয়ে চলেছি-কবে একটা বন্দরে টেনে এনে নোঙর ফেলতে পারব জানিনে। ছেলেদের মধ্যে কেউ একদিকে কেউ আর একদিকে, আমার বিদ্যালয় একদিকে এবং আমি আধিব্যাধি নিয়ে অন্যদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে চলেছি। বিচ্ছিন্ন সংসারটাকে এক জায়গায় জমাট করে নিয়ে বসবার জন্য মন ব্যাকুল হয়েছে।’ আবার জীবনের অনেক আনন্দ মুহূর্তে নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর সান্নিধ্য কামনা করেছেন। তাকে পার্থিব রূপে না পাওয়ার জন্য বেদনার্ত হৃদয়ে জীবন মুহূর্তে মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছেন, ‘সব চেয়ে কী কষ্ট হত জান ? এমন কেউ নেই যাকে সব বলা যায়। সংসারে কথার পুঞ্জ অনবরত জমে উঠতে থাকে। ঠিক  পরামর্শ নেবার জন্য নয়, শুধু বলা, বলার জন্য। আমিন কাউকে পেতে ইচ্ছে করে যাকে সব বলা যায়- সে তো আর যাকে তাকে দিয়ে হয় না।’      


তাই দেখা যাচ্ছে, এভাবেই মৃণালিনী দেবী যৌবনে মানসীরূপে, মৃত্যুতে অধরারূপে, তার জীবন মৃত্যুর দু’টি বাহু দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনকে সার্থক করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনে যে নারী কল্যাণীরূপে এসেছিলেন মানস চিত্রে ভাবনার গভীরে, তাকেই রবীন্দ্রনাথ তুলে নিলেন শিল্পীর তুলিতে।