পুত্র রথীন্দ্রনাথের (১৮৮৮–১৯৬১) ভাবনার স্মৃতিতে জেগে রয়েছে মা মৃণালিনী দেবীর অনেক অজানা কথা। যা পরবর্তী সময়ে, রথীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে তু’লে ধরেন। রথীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাবার ‘খামখেয়ালি সভা’ যখন আরম্ভ হয় তখন আমি একটু বড়ো হয়েছি। তাই এই বৈঠকের বিষয় স্পষ্ট মনে আছে। এই সভার কোনো নয়ম-কানুন ছিল না। পনের-কুড়িজন বন্ধুবান্ধব মিলে এই সভা। বাবা ও বলুদাদার উৎসাহে এর প্রতিষ্ঠা হয়। সভ্য শ্রেণীভুক্ত হবার কোনো নিয়ম না থাকলেও, লেখক কবি শিল্পী সংগীতজ্ঞ ও অভিনেতাদের নিয়েই সভা গঠিত হয়। সভার প্রথা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল প্রতি মাসে এক একজন সভ্য পালা করে তাঁর বাড়িতে অন্য সকলকে নিমন্ত্রণ করতেন।


সেদিন সেখানেই বৈঠক বসত। যদিও আহারের  প্রচুর আয়োজন থাকত- কিন্তু সেটা উপলক্ষ মাত্র। কবিতা বা গল্প পড়া, ছোটো-খাটো অভিনয় ও গানবাজনা করা এই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। বাবার যে বার নিমন্ত্রণ করার পালা পড়ল, বাড়িতে হুলস্থূল পড়ে গেল। মাকে ফরমাস দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে  হবে। মামুলী কিছুই থাকবে না, প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। ফরমাস করেই নিশ্চিন্ত হলেন না, নতুন ধরনের রান্না কী করে রাঁধতে হবে তাও বলে দিতে লাগলেন। মা বিপদে পড়লেন। তিনি প্রতিবাদ না করে নিজের মতো ব্যবস্থা করতে লাগলেন। বাবা মনে করতেন, খাওয়াটা উপলক্ষ মাত্র, রান্না ভালো হলেই হল না- খাবার পাত্র, পরিবেশনের প্রণালী, ঘর সাজানো সবই সুন্দর হওয়া চাই। যেখানে খাওয়ানো হবে তার পরিবেশে শিল্পীর হাতের পরিচয় থাকা চাই। মা রান্নার কথা ভাবতে লাগলেন, অন্যরা সাজানোর দিকে মন দিলেন। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশে ভুমিকম্প হয়। সেই সময়ে সেবার নাটোরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কনফারেন্স ডাকা হয়েছিল। নাটোরের মহারাজা নিমন্ত্রণকর্তা। আমাদের বাড়ির সকলকেই অনুরোধ  জানিয়েছিলেন তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করতে।


পুরুষরা সকলেই নাটোরে চলে গেলেন। তার দু’দিন পরেই ভুমিকম্পে কলকাতা শহর তোলপাড় করে দিল। অনেক বাড়ি পড়ল, মানুষও মারা গেল। নীচে নামবার সময় ছাদ থেকে টালি ভেঙে মা’র মাথায় পড়ল। একতলায় একটা ঘরে তাঁকে শুইয়ে রাখা হল। নিজের আঘাতের যন্ত্রণা অপেক্ষা দুশ্চিন্তা  তার বেশি হল। বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই- নাটোরে তাঁদের কী হচ্ছে খবর নেবার উপায় নেই। রেলপথ বন্ধ, টেলিগ্রাম-যাতায়াত বন্ধ। বাবা মনে করতেন রামায়ণ মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে পরিচয় শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ হওয়া উচিত। কিন্তু ছেলেদের পড়ে শোনানো যায় বা তাদের হাতে পড়তে দেওয়া যায় এমন কোনো বই তখন ছিল না। ভাষার বিশেষ পরিবর্তন করে, প্রক্ষিপ্ত ও অবান্তর ঘটনা বাদ দিয়ে মূল গল্প দুটি অটুট রেখে রামায়ণ ও মহাভারত সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করার আগ্রহ তাঁর এই সময়ে দেখা গেল। রামায়ণ সংক্ষিপ্ত করার ভার দিলেন মাকে আর মহাভারত সুরেনদাদাকে। তাঁকে বললেন কালীপ্রসন্ন সিংহের তর্জমা অবলম্বন করে সংক্ষিপ্ত করতে।


রামায়ণ সম্বদ্ধে কিন্তু মাকে বললেন মূল সংস্কৃত থেকে সংক্ষেপ করে তর্জমা করতে। পণ্ডিত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের সাহায্যে মা আগাগোড়া রামায়ণ পড়ে নিয়ে তর্জমা করতে লাগলেন। প্রয়োজনমত বাবা পরিবর্তন বা সংশোধন করে দিতেন। একটি বাঁধানো খাতাতে কপি করে রেখেছিলেন- তার থেকে মাঝে মাঝে আমাদের পড়ে শোনাতেন। মৃত্যুর পূর্বে মা এ কাজটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, তবে অল্পই বাকি ছিল। দুঃখের বিষয়, বাবার মৃত্যুর পর যখন তাঁর সমস্ত কাগজপত্র রবীন্দ্র সদনে দেওয়া হল তখন এই খাতাটি পাওয়া গেল না। শিলাইদহে থাকতে বাবা আমাদের লেখাপড়া শেখবার দিকে যেমন নজর দিয়েছিলেন, অন্য দিকে মা চেষ্টা করতেন আমাদের সবরকম  ঘরকন্নার কাজ শেখাতেন। তাঁর প্রণালী ছিল বেশ নতুন রকমের। রবিবার দিন তিনি চাকরবামুন সকলকে ছুতি দিতেন। সংসারের সমস্ত কাজ আমাদের করতে হত। রান্নার কাজে আমার খুব উৎসাহবোধ হত- রান্না কেমন হল, তা বুঝবার জন্য রাঁধুনির মাঝে মাঝে চেখে দেখার স্বাধীনতায় কেউ তো বাধা দিতে পারে না।  


লেখার ফাঁকে ফাঁকে যখন বাবাকে গান পেয়ে বসত-অমলাদিদিকে কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন। দিনের বেলায় অমলাদিদি মায়ের সঙ্গে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মুখরোচক নানারকম ঢাকাই রান্নাতে তাঁর হাতযশ ছিল- মা তাঁর কাছ থেকে সেই সব রান্না শিখে নিতেন। আর মা শেখাতেন তাঁকে যশোহর অঞ্চলের নিরামিষ ব্যঞ্জন রাঁধার পদ্ধতি। সন্ধে হলেই, অন্য সব কাজ ফেলে গান শোনবার জন্য সবাই সমবেত হতেন। মাঝিরা জলিবোটটা বজরার গায়ে বেঁধে দিয়ে যেত। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে জানলা দিয়ে টপকে সেই বোটটাতে গিয়ে বসতুম। সুরেনদাদার হাতে এসরাজ থাকত। জলিবোট  খুলে মাঝ দরিয়ায় নিয়ে গিয়ে নোঙর ফেলে রাখা হত।


তাঁর পর শুরু হত গান- পালা করে বাবা ও অমলাদিদি গানের পর গান গাইতে থাকতেন। আকাশের সীমান্ত পর্যন্ত অবারিত জলরাশি, গানের সুরগুলি তার উপর দিয়ে ঢেউ খেলিয়ে গিয়ে কোন সুদূর যেন মিলিয়ে যেত, আবার ওপারের গাছপালার ধাক্কা খেয়ে তার মৃদু প্রতিধ্বনি আমাদের কাছে ফিরে আসত। ক্রমে রাত্রি গভীর হলে চারিদিক নিঝুম  হয়ে আসত। নৌকা চলাচল তখন বন্ধ। বোটের গায়ে  থেকে থেকে ঢেউগুলি এসে লাগছে এবং কুলকুল শব্দ করে স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো পড়ে নদির জল কোথাও ঝিকিমিকি করে ওঠে। কখনো দু- একটা জেলে ডিঙ্গিতে মাঝিরা ভাতিয়ালি সুরে দাঁড় ফেলার তালে   তালে গান  গাইতে গাইতে চলে যায়। গানের আসর ভাঙবার আগেই আমি মার কোলে ঘুমিয়ে পড়তুম।


বাবা সমস্তদিন ধরে লিখতেন তার ঘরে-সেখানে আমাদের প্রবেশ নিষেধ- মা বারণ করে দিয়ে ছিলেন। লেখার ঝোঁক যখন বেশি চাপত তখন খাওয়া–দাওয়া এক রকম ছেড়ে দিতেন। মা খুব রাগারাগি করতেন কিন্তু তাতে কোনো ফল হত না। একটি ঘটনার কথা মনে পড়েঃ বাবা তখন সরলাদিদির উপর ‘ভারতীর’ সম্পাদনভার ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে তার ভার লাঘব বিশেষ কিছু হল না। লেখার জন্য তাঁর উপর দাবি সমানই থেকে গেল। প্রতিমাসেই সরলাদিদির কাছ থেকে তাগিদের চিঠি আসে। সরলাদিদির ভারতীর জন্য বাবাকে একটা প্রহসন লিখে দিতে বলেন কিন্তু বাবার সময় আর হয় না। এ দিকে বড়ো লেখা না হলে সরলাদিদির চলে না, তাই তিনি গত্যন্তর না দেখে তাঁর কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বসলেন যে, পরের মাস থেকে ‘ভারতী’তে নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রহসন বেরোবে। ভারতীর পক্ষ থেকে ঔপন্যাসিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় একটি চিঠিতে বাবাকে বিজ্ঞাপনের খবরটাও জানিয়ে দিলেন। চিঠি পেয়ে বাবা প্রথমত একটু বিরক্ত হন। কিন্তু সরলাদিদিকে বিপদগ্রস্ত করতে পারেন না, কাজেই অবিলম্বে লেখায় হাত দিলেন। ‘আমি লিখতে যাচ্ছি- খাবার জন্য আমাকে ডাকাডাকি কোরো না’, এই বলে তিনি লিখতে বসে গেলেন। খেতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়, তাই খাওয়া- দাওয়া ছেড়ে সমস্ত দিন ধরে লিখতে লাগলেন। মা মাঝে মাঝে ফলের রস বা শরবত তাঁর টেবিলে রেখে আসতেন। যখনই এই প্রহসনের মাসিক কিস্তি পাঠাবার সময় হত, বাবা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে লেখায় ভুবে যেতেন।


একবার এ রকম একটা মাসিক কিস্তি লেখা সবেমাত্র শেষ হয়েছে, বাবা মাকে বললেন, ‘আমার গল্পটা লেখা শেষ হয়ে গেছে, আমাকে এখনি কলকাতায় যেতে হবে।’ এই কথা শুনে মা কিছুমাত্র আশ্চর্য হলেন না। তিনি জানতেন, কোনো লেখা শেষ হলে সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবদের সেটা যতক্ষণ না পড়ে শোনাচ্ছেন-বাবা স্বস্তি বোধ করতেন না। এই অভ্যাস তাঁর বরাবর থেকে গিয়েছিল। গল্পটার তখন নাম দিলে ‘চিরকুমার সভা’। পরে এটা পুস্তকাকারে  ছাপা হয়েছিল ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ নামে। এই নামটি বোধ হয় বাবার বিশেষ পছন্দ হয়নি। উপন্যাসটি যখন নাটকে পরিবর্তিত হল তখন তার নাম ‘চিরকুমার সভা’ই রইল।  
লেখার খাতা নিয়ে বাবা চলে গেলেন কলকাতায়। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম ও তার উপর অতিরিক্ত মানসিক  পরিশ্রমের ফলে সেবার এত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে তেতলার ঘরে উঠতে সিঁড়িতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই ঘটনার পর খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তাঁর আর স্বাধীনতা রইল না, মায়ের ব্যবস্থাই তাঁকে মেনে চলতে হত।  


ইস্কুলের বোর্ডিঙে আমি থাকব- মায়ের সেটা ভালো লাগত না। বিশেষভাবে তাঁর খারাপ লাগত ইস্কুলের রান্নাঘরের  বামুনদের বিশ্রী রান্না আমাকে খেতে হচ্ছে মনে করে। কিন্তু বাবার বিশেষ ইচ্ছে আমি অন্যান্য ছেলেদের মত বোর্ডিঙে থাকি, তাই তিনি কোনো আপত্তি কখনো প্রকাশ করেননি। বুধবার ছুটির দিন মা মনের আক্ষেপ মেটাতে চেষ্টা করতেন। বাড়িতে তিনি সেদিন নিজে রান্না করতেন- আমার সঙ্গে বোর্ডিঙের সব ছেলেরাই খেতে আসত। এই নিয়মিত খাওয়াতে কিন্তু আমাদের যথেষ্ট তৃপ্তি হত না- বেশি ভালো লাগত যখন দল বেঁধে অসময়ে এসে মায়ের ভাঁড়ার ঘর লুট করে নিয়ে যেতেন। তিনি পরে জানতে পেলেও আমাদের কিছু বলতেন না।


শান্তিনিকেতনে নিজেদের বাসের জন্য পৃথক বাড়ি তখন ছিল না, আমরা থাকতুম আশ্রমের অতিথিশালার দোতলায়। রান্নাবাড়ি ছিল দূরে। মা রান্না করতে ভালোবাসতেন, তাই দোতলার বারান্দার এক কোণে তিনি উনুন পেতে নিয়েছিলেন। ছুটির দিন নিজের হাতে রেঁধে আমাদের খাওয়াতেন। মা নানারকম মিষ্টান্ন করতে পারতেন। আমরা জানতুম, জালের আলমারিতে যথেষ্ট লোভনীয় জিনিস সর্বদাই মজুত থাকত-সেই অক্ষয় ভাণ্ডারে সময়ে অসময়ে সহপাঠীদের নিয়ে এসে দৌরাত্ম্য করতে ত্রুটি করতুম না। বাবার ফরমাশমত নানারকম নতুন ধরনের মিষ্টি মাকে প্রায়ই তৈরি করতে হত। সাধারণ গজার একটি নতুন সংস্করণ একবার তৈরি হল, তার নাম দেওয়া হল ‘পরিবন্ধ’। এটা খেতে ভালো, দেখতেও ভালো। তখনকার দিনে অনেক বাড়িতেই এটা বেশ চলন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একদিন বাবা যখন মাকে মানকচুর জিলিপি করতে বললেন, মা হেসে খুব আপত্তি করলেন, কিন্তু তৈরি করে দেখেন এটাও উতরে গেল। সাধারণ জিলিপির চেয়ে খেতে আরোও ভালো হল। বাবার এইরকম নিত্য নতুন ফরমাশ চলত, মা-ও উৎসাহের সঙ্গে সেইমত করতে চেষ্টা করতেন।


কলকাতায় মা আত্মীয়স্বজনের স্নেহবন্ধনের মধ্যে একটি বৃহৎ পরিবারের পরিবেশের মধ্যে ছিলেন। তাঁকে সকলেই ভালোবাসতো, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তিনিই প্রকৃতপক্ষে কর্ত্রী ছিলেন। সেই জন্য কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে থাকা তাঁর পক্ষে আনন্দকর হয়নি। অস্থায়িভাবে অতিথিশালার কয়েকটা ঘরে বাস করতে হল, সেখানে গুছিয়ে সংসার পাতার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তাঁর নিজের পক্ষে সেটা যতই কষ্টকর হোক তিনি সব অসুবিধা হাসিমুখে মেনে নিয়ে ইস্কুলের কাজে বাবাকে প্রফুল্লচিত্তে সহযোগিতা করতে লাগলেন। তার জন্য তাঁকে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে, নিজের অলঙ্কার একে একে বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়েছেন। শেষপর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি অ গলায় একটি চেন ছাড়া তাঁর কো নো গয়না অবশিষ্ট ছিল না। মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরানো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে সব অন্তর্ধান হল। বাবার নিজের যা কিছু মূল্যবান সম্পত্তি ছিল তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন।


যে বিদ্যালয় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটা তাঁর সাময়িক শখের জিনিস ছিল না। বহুদিন ধরে  যে শিক্ষার আদর্শ তাঁর মনের মধ্যে কল্পনার আকারে ছিল তাকেই রূপ দিতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তিনি কেবল আদর্শবাদী ছিলেন না, আদর্শকে রূপায়িত না করতে পারলে তাঁর তৃপ্তি ছিল না। তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করা, যতই তা কঠিন হোক না কেন, তিনি যথেষ্ট মনে করতেন না। সেই ত্যাগ স্বীকারে মা তার অংশ স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের আত্মীয়েরা মাকে এই জন্য ভৎসনা  করতেন, বাবাকে তো তাঁরা কাণ্ডজ্ঞানহীন অবিবেচক মনে করতেন। বহুকাল পর্যন্ত বাবাকে, আর মা যতদিন বেঁচেছিলেন তাঁকে, বাড়ির লোকদের কাছ থেকে  বিদ্যালয় সম্পর্কে বিদ্রুপ ও বিরুদ্ধতা সহ্য করতে হয়েছিল।


রথীন্দ্রনাথ, স্মৃতি কথায় আবার লিখেছেন, ‘কলকাতায় মা আত্মীয়স্বজনের স্নেহ বন্ধনের মধ্যে একটি বৃহৎ পরিবারের পরিবেশের মধ্যে ছিলেন। সেই জন্য কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকতনে এসে থাকা তাঁর পক্ষে আনন্দকর হয়নি। অস্থায়ী অতিথিশালার কয়েকটা ঘরে বাস করতে হল, যেখানে গুছিয়ে সংসার পাতার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তাঁর নিজের পক্ষে সেটা যতই কষ্টকর হোক, তিনি সব অসুবিধা হাসিমুখে মেনে নিয়ে ইস্কুলের কাজে বাবাকে প্রফুল্লচিত্তে সহযোগিতা করতে লাগলেন। তাঁর জন্য তাঁকে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে নিজের অলঙ্কার একে একে বিক্রি করে বাবাকে দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন ছাড়া আর কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না।’  
    
শান্তিনিকেতনে কয়েকমাস থাকার পর মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকল। যখন নিতান্তই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন তাঁকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হল। বাবা তখন কলকাতায়, দাদা দ্বিপেন্দ্রনাথকে লিখলেন মাকে নিয়ে কলকাতায় আসতে। বোলপুর থেকে কলকাতায় মাকে নিয়ে সেই যে যাওয়া- আমার কাছে  চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে একটি সামান্য কারণে। মা শুয়ে আছেন, আমি তাঁর পাশে বসে জানলা দিয়ে একদৃষ্টে দেখছি- কত তালগাছের শ্রেণী, কত বুনো খেজুরের ঝোপ, কত বাঁশঝাড় ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম, কখনো চোখে পড়ল মস্তবড় মহিষের পিঠে নির্ভয়ে বসে আছে এক বাচ্চা ছেলে- এই সব গ্রাম্যদৃশ্য চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার ছবির মতো চলে যাচ্ছে। একসময়ে নজরে পড়ল জনশূন্য মাঠের মাঝে ভাঙা পাড় অর্ধেক বোজা একটি পুকুর-তার যেটুকু জল আছে, ঢেকে গেছে অসংখ্য শাদা পদ্মফুলে।   দেখে এত ভালো লাগলো, মাকে ডেকে দেখালুম। তার পর কত বছর গেছে, প্রতিবারই বোলপুর কলকাতা যাতায়াতের সময় সেই পদ্মপুকুর দেখার চেষ্টা করি। কেবল দেখতে পাই- পুকুরে জল নেই, মাটি ভরে মাঠের সঙ্গে পুকুর সমান হয়ে গেছে, পদ্ম সেখানে আর ফোটে না।


কলকাতায় এসে মা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তাররা কী অসুখ ধরতে না পারায় বাবা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাতে লাগলেন। তখনকার দিনের  প্রসিদ্ধ ডাক্তাররা- প্রতাপ মজুমদার, ডি,এন, রায় প্রভৃতি সর্বদাই বাড়িতে আসতে থাকলেন। তাঁরা সকলেই বাবাকে সমীহ করতেন, এমনকি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় তাঁদের সমকক্ষ মনে করতেন। মায়ের চিকিৎসা সম্বন্ধে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করেই তাঁরা ব্যবস্থা দিতেন। এদের চিকিৎসা ও বাবার অক্লান্ত সেবা সত্ত্বেও মা সুস্থ হলেন না। আমার এখন সন্ধেহ হয় তাঁর আপেনডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা ছিল না, অপারেশনের প্রণালীও আবিষ্কৃত হয়নি।  


মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপাশে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর  বাকরোধ হয়েছে। আমাকে  দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের  সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরানো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারা রাত কাটল। ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা  অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ। নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।


সমবেদনা জানাবার জন্য সেদিন রাত পর্যন্ত লোকের ভিড়। বাবা সকলের সঙ্গেই শান্তভাবে ধৈর্যের  সঙ্গে কথা বলে গেলেন, কিন্তু কী কষ্টে যে আত্মসংবরণ করে তিনি ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারছিলুম। একমাস ধরে তিনি অহোরাত্র মার সেবা করেছেন, নার্স রাখতে দেননি, শ্রান্তিতে শরীর মন ভেঙে পড়ার কথা। তার উপর শোক। যখন সকলে চলে গেল, বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে মায়ের সর্বদা ব্যবহৃত চটিজুতো যোড়াটি আমার হাতে দিয়ে কেবলমাত্র বললেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।’ এই দুটি কথা বলেই নীরবে তার ঘরে চলে গেলেন। মায়ের সেই চটি এখন রবীন্দ্রসদনে সযত্নে  রক্ষিত রয়েছে। মায়ের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই আমরা শান্তিনিকেতনে চলে এলুম। বাবা বিদ্যালয়ের কাজে আরো যেন মন ঢেলে দিলেন। কাজের ফাঁকে নিভৃতে বসে শোকদগ্ধ হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করলেন গুটিকতক কবিতায়-যা বই আকারে পরে বেরিয়েছিল ‘স্মরণ’ নাম দিয়ে।