সাম্যবাদী ধারার অন্যতম কবি সুকান্ত। ‘ছাড়পত্র’ (১৯৪৯) সুকান্তর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘ছাড়পত্র’ সর্বাধিক সুপরিচিতি এবং সুগঠিত। সুকান্তর কাব্যগ্রন্থগুলো তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হ’তে থাকে। কবিতার সংখ্যার দিক দিয়ে ‘ছাড়পত্র’ প্রথম। ‘ঘুম নেই’ কবিতার সংখ্যার দিক দিয়ে ‘ছাড়পত্রের’ সমতুল্য। জন্মমাত্র ‘সুতীব্র চিৎকারের মধ্যে দিয়েই কবি বুঁঝে উঠতে পেরেছিলেন নতুন বিশ্বের কাছে ব্যক্ত করে তাঁর অধিকার। এই নতুন শিশুর ভূমিষ্ঠর সাথে সাথে নিজের দায়িত্ব কর্তব্য বা পালনীয় কার্যগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটান তিনি। পৃথিবী অসুস্থময় এবং অবাসযোগ্য হওয়াতে কবি চিন্তিত হয়ে পড়েন নতুন শিশুর আগমনের সাথে সাথে। কবি হিশেবে তাই অঙ্গীকারবদ্ধ হোন নতুন শিশুর কাছে। একটি সুস্থ এবং সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়ার স্বপ্ন গেঁথে থাকে কবির দু’চোখে। এবং তিনি সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকেন। কতটা সফল হ’য়ে ওঠেন তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। নতুন শিশুর আগমনকে কবি নতুন বিশ্বে আগমনের ঘটনাকে ছাড়পত্রের সাথে তুলনা করেন।


মাতৃকোলে শিশুর আনন্দকে কবি শিশুর অধিকার আদায়ের দাবি বলে মেনে নেন। বর্তমান থেকে ভবিষ্যগামী ছিলেন সুকান্ত। মৃত্যুর ব্যাপারটিকে আমরা আপাত দৃষ্টিতে ছাড়পত্রের সাথে তুলনা করতে পারি। সুকান্ত, তাঁর জীবনের কর্ম, দায়িত্ববোধ, বেদনা, হাঁহাকার, মনোভাবনা এবং শূন্যতাবোধ নিয়েও একটি কবিতা সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু সুকান্ত বেছে নেননি এরকম কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা। হাহাকার, শূন্যতাবোধ বা নিঃসঙ্গতার থেকেও নতুন শিশুর আগমন বার্তাকে ছাড়পত্র বলে তিনি নতুনের আগমনের মধ্যে দিয়ে তাদের জয়ধ্বনি প্রকাশ করেন। এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন একটি সুন্দর এবং বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেওয়ার। সুকান্ত স্বল্পায়ু কবি, কিন্তু কবিতায় অজর।


সুকান্ত যদি অপর দু’টি কাব্যগ্রন্থ রচনা না করতেন তাহ’লে একমাত্র ‘ছাড়পত্র’-এর দিকে দৃষ্টি দিলে কারো বুঝে উঠতে কষ্ট হতো না যে তিনি কতটা মৌলিক ও সৃষ্টিশীল কবি। সুকান্তর সৃষ্টি ও মননশীলতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ তাঁর ‘ছাড়পত্র’। আমার কাছে অন্যতম গ্রন্থ। ছাড়পত্রের একাধিক কবিতা শ্রেষ্ঠও প্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এ প্রসঙ্গে- আমি উল্লেখ করতে চাই, সাম্প্রতিক সময়ে “আধুনিক বাঙলা কবিতা ” (হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত : ১৯৯৪) নামক সু-সম্পাদিত গ্রন্থটি-তে সুকান্তর সাতটি কবিতার মধ্যে ছয়টিই নেওয়া হয় ‘ছাড়পত্র’ থেকে।


যে ব্যাপারটি আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থ থেকে যদি শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্বাচন করা হয় তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি এ কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। শ্রেষ্ঠ বলতে সাধারণভাবে যা বোঝায় যে অনেকগুলো থেকে অল্পকিছু নির্বাচন। আমার মনে হয় এ কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে ওই নিয়মগুলো মেনে চলা বেশ কষ্টকর হ’য়ে দেখা দেয়। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো শ্রেষ্ঠতা মানলে তা বেশি ছাড়া কম হবে না। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের “রবীন্দ্রনাথের প্রতি” কবিতাটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। যে কবিতাটি আমি বহুবার পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি তাঁকে কিভাবে মোহিত করে তা তিনি প্রকাশ করেছেন স্বচিত্তে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং গান অন্যে সকলের মতো কবি সুকান্তর কাছেও যে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিতে পারে তা তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতার পঙ্ক্তির মাধ্যমে। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’কবিতায় কবি সুকান্ত ‘আমি এক দুর্ভিক্ষে কবি’ ব’লে নিজেকে নিজে প্রকাশ করেন। যখন সুকান্ত প্রার্থনা করেন সমাজের নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষের জন্য। জ্বলজ্বলে বা অগ্নিময় সূর্যকে যখন তিনি একটু উত্তাপের জন্য প্রার্থনা করেন, তখন সূর্যকে আমার নিকট আর সূর্য মনে হয় না। মনে হয় তিনি যেন কোনো ব্যক্তির নিকট আকুল আবেদন করছেন, তাঁর বা সেই দুঃখ কাতর সমাজের মানুষের জন্য।


‘একটি মোরগের কাহিনী’ বা ‘সিঁড়ি’ কবিতাগুলোকে মনে হয়েছে ‘আত্মকথন’ নির্ভর কবিতা বলে। ‘ঠিকানা’ কবিতায় কবি সুকান্ত নিজের ঠিকানা জেনে নেবার জন্য প্রকাশ করেন কয়েকটি দেশের নাম: ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুশ বা চীনে। সুকান্তকে আমরা পাই বিভিন্ন দেশে বা বিভিন্ন লোকের মধ্যে; যাঁরা সমাজে অবহেলিত। সুকান্ত নিজে কমিউনিস্ট দলের কর্মী হয়ে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেন বাম রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে। এর পরের কবিতাটি উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় ‘লেনিন’ নামটি। যে নামের মধ্যে সুকান্ত দেখতে পান অন্যায়ের মুখোমুখি প্রথম প্রতিবাদ কারীকে। লেনিন এর মধ্যে কবি খুঁজে পান মুক্তির দূত হিশেবে কিছু দেশকে। আরো অগ্রগামী হ’লে পাবো আরো কিছু কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাদেরকে আকর্ষণ করতে পারে ক্ষণে ক্ষণে।


‘বোধন’ নামক পাওয়া যাবে একটি দীর্ঘ কবিতা। যে কবিতায় কবি মহামানব-এর নিকট করুণ প্রার্থনা বা আবেদন করেন একবার চোখ মেলে তাঁর নগর-গ্রামের চিত্রগুলো দেখার জন্যে। যেখানে মৃত্যু আসে বার বার, ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল বা নির্জনতার কালো অন্ধকার হ’য়ে।


১৯৪৪, যখন সুকান্ত আঠারো বছরের তরুণ যুবক। এই বয়সেই দেখা দেয় কয়েকটি উল্লেযযোগ্য কবিতা। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘কৃষকের গান’, ‘এই নবান্নে’, ‘হে মহাজীবন’, ‘চির দিনের’, ‘নিভৃত’ এবং আঠারো বছর বয়স’ ইত্যাদি। এই সকল কবিতাগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হ’য়ে দেখা দেয়, দুটি কবিতা ঃ ‘আঠারো বছর বয়স’ এবং ‘হে মহাজীবন’। যে কবিতা দুটি দেখা দেয় জনপ্রিয় ও আলোচিত হয়ে। আঠারো বছর বয়স, কবিতাটিতে এই বয়সে কী হতে পারে বা পারে না তাঁর ষ্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে সমস্ত কবিতাটির শরীর জুঁড়ে। নতুন কিছু করার বাসনা, বেদনায় পরিপূর্ণ মন, রক্তদানের পুণ্য ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আঠারো যেন আসে তবুও প্রত্যেকের জীবনে। এই কবিতাটিতে শুধু কবি সুকান্তর আঠারোই উঠে আসেনি, বরং এসেছে এর পরবর্তী  নতুন কিছু করা বা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বাসনা। তাই আমরা চাই প্রত্যেকের জীবনে নেমে আসুন আঠারো। আট পঙ্ক্তি বিশিষ্টি ‘হে মহাজীবন’ কবিতাটি সুকান্তর মুলসুর। মহাজীবনের কাছে তিনি আহবান করেন, আর যেন কাব্য তাকে ধরা না দেয়। কবিতার স্নিগ্ধতা তাঁকে কতটা মুগ্ধ করেছে তা তাঁকে বুঝে উঠেছেন। তাই ওই কবিতা থেকে বেড়িয়ে এসে কঠিন গদ্যের জন্যে অপেক্ষা করেন। সুকান্তর কবিতায় উপমা, অলঙ্কার উৎপেক্ষা বিভিন্ন সময়ে এসেছে বিভিন্নভাবে।


‘হে মহাজীবন’- কবিতায় তাঁর সার্থক ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। কবি সুকান্ত, কাব্যিক চেতনাশ্রয় থেকে যখন বাস্তবের দিকে অগ্রগামী হ’তে থাকেন, তখন তিনি বুঝে উঠতে পারেন কবিতার সৌন্দর্যে বা বিস্ময় বিমুগ্ধে আর জীবন কাটে না। ঠিক তখনই তিনি ধরা দেন বাস্তবের সবচেয়ে নির্মম স্থানটিতে। যখন তিনি ‘চাঁদকে’ তুলনা করেন ‘ঝলসানো রুটির সাথে’। ‘গোলগাল সৌন্দর্যময় চাঁদ যখন আর আবেদন জাগায় না ভিতরে কবিতা সৃষ্টির জন্যে। একদা ওই সৌন্দর্যময় চাঁদ থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান হ’য়ে ওঠে ঝলসানো রুটি। ওই ঝলসানো রুটি-ই দিতে পারে জীবন আর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। আর ঠিক তখনই হীন হতে থাকে ভাসমান সৌন্দর্র্যময় চাঁদটি। ‘হে মহাজীবন’ কবিতায় আর তিনি আচ্ছন্ন থাকতে চান না। যে ভাবে তিনি কাঁটিয়েছেন কবিতায় নিমগ্ন ভাবে। তাই এক সময় এসে তিনি বুঝে উঠেন ছুটি দিতে হবে কবিতাকে। মায়াজালে তাঁকে আর আটকে রাখা যাবে না। বেছে নিতে হবে নির্মম সত্যকে। আর সেই সত্যকে গ্রহণ করতে হলে কবিতার বদলে তুলে নেন কঠিন গদ্যকে কবি সুকান্ত বুঝে উঠতে পারেন; ক্ষুধার রাজ্যের আর স্নিগ্ধমোহিত কবিতা চলতে পারে না।