কবিতা---- আমি চিনি পৃথিবীটাকে
লেখক--- হিরণ্ময় ঘোষ
----------------------------------------
আমি মায়া, সমাজের চোখে এক অবলা মেয়ে ।
আমায় চেনে না কেউ। আমি চিনি পৃথিবীটাকে !


বুকের ভেতর লালায়িত এক স্বপ্ন দেখতাম প্রায়ই,
কোন এক নদীর তীরে -ছোট্ট এক কুঁড়েঘর,
ভালোবাসা দিয়ে গড়া এক চিলতে -একটি বাগান;
বাতাস ভরে থাকত সেখানে নানা ফুলের সৌরভে।


এই স্বপ্নটুকু সব মেয়েরাই দেখে বোধহয়,
আমাদের মত দরিদ্রদের স্বপ্নে থাকে- ছোট্ট কুঁড়ে ঘর;
আর পয়সাওয়ালাদের এক সুদৃশ্য অট্টালিকা।
দেওয়াল গুলোর পরতে পরতে থাকে অহংকার।


আমাদের মতো মায়াদের মেয়ে জন্ম কেন হয় জানিনা !
জন্মের সময় সকলে থাকে মুখ ফিরিয়ে। বাবা ভাসে চোখের জলে।
তারপর ধীরে ধীরে মেনে নেয়। গৃহপালিত জীবের মত বড় হই ভাইয়ের সাথে।
উঠতে-বসতে শুনতে হয়, মেয়ে জন্মের কত খোঁটা। সকলে কত কথাই না বলে।


ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়,
একে একে মানিয়ে চলতে হয় সবার সাথে।
তারপর একদিন পড়াশোনার ইচ্ছাটাকে পিষে মেরে ফেলে,
চলে যেতে হয় কারো এক হাত ধরে। সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।


আমাদের সব মেনে নিতে হয়। আমাদের সব মানিয়ে নিতে হয়।
কারো কারো কপালে সুখ জোটে শুনেছি,
আবার অনেকেই ,আমার মত স্বামীর কেনা দাসী হয়ে থাকে।
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে শরীর দিতে হয় স্বামীকে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পেটের সন্তান নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় কাজের সন্ধানে-
নিত্য লেগে থাকা অভাব-অনটনের কলহ মুখর রোজনামচায়।


সবকিছু মেনে নিয়ে তবু, মুখ বুজে পড়ে থাকি এক কোণে।
তারপর একদিন বাতিলের খাতায় ! ড্যাং ড্যাং করে ঘরে আসে সতীন।
অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে পারিনা। সন্তান নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় রাস্তায়।
হয়তো, আইন শুধু পয়সা চেনে; পয়সা ছাড়া কাউকে দেয় না পাত্তা।


বাবা মা অনেক দিন আগেই দায় ভেবে ঝেড়ে ফেলেছিল,
ভাইয়ের সংসারে এখন তারা অসহায় মুখে থাকে।
অনেক ঘোরাঘুরির পর ফুটপাত হয় জীবন।
শত পুরুষের নোংরা ব্যবহারে, নেমে আসে আস্ত একটা নরক।


আমি মায়া, সমাজের চোখে এক অবলা মেয়ে ।
আমায় চেনে না কেউ। আমি চিনি পৃথিবীটাকে !


এখন আমি এক সাহেবের বাংলোয় কাজ করি,
পৃথিবীতে সবাই যে খারাপ তা কিন্তু নয়।
কেউ কেউ হয় খুব ভালো ,একেবারে দেবদূত যেন।
সাহেবের কৃপায় ছেলেটা কাজ পায় এক কারখানায়।
চার হাতের রোজগারে সরে যাচ্ছে জমাটবাঁধা সেই দুঃখের মেঘটা।
নতুন সূর্যের নতুন কিরণে আবার সেই স্বপ্নটা দেখি রোজ,
তবে নতুন ভাবে-----
ফুটপাতে একটা রুটির দোকান, 'মায়া রুটি সেন্টার'
না খেতে পাওয়ার যন্ত্রনা গুলো মিটে গেছে সব যেন
পরম মমতায় নিজ হাতে গড়া রুটি খাওয়াচ্ছি দুখী পৃথিবীটাকে।


আমি মায়া, সমাজের চোখে সেই অবলা মেয়ে।
আমায় চেনে না কেউ। আমি চিনি পৃথিবীটাকে।
---------------  ০৬/০৯/২০২০ ------------