দিন তারিখ আজ আর ঠিক মনে নেই , ১৯৮২ র অক্টোবর নভেম্বরের কোন একটি দিন হবে হয়তো । রামকৃষ্ণ এল সকাল সকাল । ছেলেটি আমারই সমবয়সী , আমার দাদার কাছে পড়তো । ওর বাড়ী ছিল কান্দি । ছেলেটার সঙ্গে একপ্রকার বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে গেছিল । আমরা তখন হালতুর রামলাল বাজারে ভাড়া বাড়িতে থাকি ।
                তখনও বাইপাস হয় নি । তবু জমজমাট ছিল জায়গাটা । মিনিট দশেক হেঁটে পালবাজারের রেলগেট পেরিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে যাওয়া ছিল সহজ ।  
              রামকে বললাম - চল্ । ও জানতে চাইল , কিন্তু খোলসা করলাম না ইচ্ছে করে । হাঁটা লাগালাম । সাঁপুইপাড়া , পালবাজার পেরিয়ে স্টেশন রোড ধরে ৮বি স্ট্যান্ড ।
             স্ট্যান্ডের বাঁপাশ ঘেষে গলি গলি একটু এগিয়ে ডানহাতে পুবমুখো টিনের বাড়ী । বাইরের দেয়ালে লাগানো বাসিন্দার নাম দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল । রামের চোখ তখন বেরিয়ে আসে আর কি !
          সাহসে ভর করে কলিং বেল টিপে দিলাম । ঐ জিনিসটা আমার ছোট থেকেই একটু বেশী । দেশের বাড়িতে এই জন্যেই কুখ্যাতি আমার বরাবর ।
         দরজা মচ্ মচ্ করে হাট হল । বিখ্যাত মানুষটির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল তাঁর বিখ্যাত দাঁতের সারি ।
         শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় । বিখ্যাত সাহিত্যিক ।
- কাকে চাই ?
- আপনাকে স্যার ।
- এসো ।
        উনি সস্নেহে ঘরে নিয়ে বসালেন । অচেনা দুটো অল্প বয়সী ছেলেকে ।
       - বলো , বাসা কোথায় ?
      - বাড়ী তো স্যার কোচবিহারে । এখানে রামলাল বাজারে থাকি ।
       - কি করা হয় ?
      - স্যার ছাত্র । একটু লেখালেখির চেষ্টা করি ।
      - বেশ বেশ । তা কি লেখো ?
      - কবিতাই লিখি , গল্প লেখারও চেষ্টা করি ।
      - বেশ বেশ । আচ্ছা , কোচবিহারে কোথায় থাকো ?
      - এই , খাগড়াবাড়ি বলে একটা জায়গা আছে , সেখানে ।
       - খাগড়াবাড়ীর কোথায় ?
       ভাবলাম উনি কি অত বুঝবেন । বললাম , খাগড়াবাড়ী থেকে একটা রাস্তা আলিপুরদুয়ার গেছে , তার ধারে ।
       - ডোডেয়ারহাটে ? হরেন ডাক্তারের বাড়ীর আশেপাশে ?
         তখনও আমার আকাশ থেকে পড়ার বাকি ছিল ।
         বললাম , না না , আরেকটু উত্তরে ।
        - কালিবাবুর বাড়ির কাছে , শীতলা পুজো হয় যেখানে ?
        আমার মুখ তো হা । আপনি স্যার এত জানেন !
        - আরে , তোমরা জানো না , আমিও কোচবিহারের ছেলে । তখনকার ভিক্টোরিয়ায় পড়েছি আর ঘুরে বেরিয়েছি ।
         চা এল । খেলাম । আমার গল্পের খাতা দিলাম । উনি হাত বাড়িয়ে নিলেন । আমরাও প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম একরাশ বিস্ময় নিয়ে ।
         - আবার এসো । খাতা নিয়ে যেও ।
          আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি । গতবছর এক পুরস্কার বিতরণী সভায় দেখা হয়েছিল , কিন্তু এত বড় বড় মানুষের ভিড়ে কথা বলে উঠতে পারি নি ।
          উনি এখন যোধপুরে পার্কে নিজস্ব বাড়ীতে থাকেন বলে শুনেছি । থাকুন উনি , ভালো থাকুন । একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে আবার , এই আশায় আছি ।