যেদিন ভূমিষ্ঠ হলাম-
সেদিন কি তোকে ভালোবেসেছি?
স্বার্থপরের মত শুষে নিয়েছি বুকের দুধ।
জঠরে শুষেছি রক্ত,আমি হয়েছি পোক্ত;
মা আমি সেদিনও স্বার্থপর ছিলাম।।


সাতদিনের জ্বরে কাতর তোকে-
ঘুমোতে দেইনি  সারারাত।
তোর কোলে মাথা গুঁজে কেঁদেছি,ক্ষুধা মিটিয়েছি;
আমি সেদিনও স্বার্থপরই ছিলাম।।


শীতের কনকনে ভাব,রক্ত জমাট বেঁধে যায় প্রায়;
বিছানা ভিজিয়ে নষ্ট করেছি নিদ্রা।
সিক্ত বিছানায় শুয়ে আমাকে দিয়েছে সুখ
মা,সেদিনও তো আমি স্বার্থপর ই ছিলাম।।


মনে পড়ে মা,
মামা বাড়ি যাবার সময় মাইলের পর মাইল আমাকে কোলে করে হাটতিস।
বোরকার পিচ্ছিল কাপড়ের কোলে-
ঘুমন্ত আমি ঢলে পড়তাম
সান্তনা দিয়ে বলতিস,
ঐ যে সামনের নদী,খেয়া ঘাট;
পার হলেই তোর মামাবাড়ি।
তবুও সে দিন ঘুম ভাঙেনি আমার।
কাদা মাটির মত দলিত-মলিত হয়ে-
ঘুমিয়েছি তোর কোলে।
কত কষ্টই না হয়েছিল তোর!
সেদিন কি আমি স্বার্থপর ছিলাম না মা?


ছ'বছর বয়সে চুলোর কয়লার আগুনে পা দিয়েছি।
মা,মা বলে চিৎকার করেছি;
তুই নামাজ ছেড়ে চলে এসেছিলি।
কোলে করে দুই কিলো দূরে
গঞ্জের ডাক্তারের পায়ে পড়ে-কি মিনতি তোর মা!
আমার সন্তান আগুনে পা দিয়েছে-
ও হাঁটতে পারবে তো?
খেলতে পারবে তো-
আফজাল সোহেলের সাথে আগের মত?
সারারাত পাশে বসেছিলি,
কেঁদেছিলি খুব।


বারবার বলতিস,কেমন লাগছে বাবা?
একটু ঘুমোবি?
আমাকেও ঘুমোতে দে।
ঘুমোতে দেইনি;
প্রদীপের আলো নিভলেই কেঁদে উঠেছি।
অন্ধকার আমি ভীষণ ভয় পেতাম।
নিজেই অন্ধকার সরিয়ে দিলে-
ত্যাগে,মমতায় আর প্রেমে
সেদিনও কি আমি জঘন্য স্বার্থপর ছিলাম না মা?


আমাকে গোসল করিয়ে,পরিপাটি করে স্কুলে পাঠিয়ে,বাড়ির সব কাজ-
স্বামী সেবাও করতিস মা তুই।
স্কুল থেকে ফিরে,খাবার পেতে দেরি হলে,
কত বিশ্রীভাবে কেঁদেছি,চিৎকার করেছি,
তবে ভেবে দেখ, কতটা স্বার্থপর ছিলাম!


স্কুলের মাইনে জোগাতে-
নিজের অসুখে পথ্য না কিনে ভুগেছিস।
ঈদ-আয়োজনে আমার কত চাহিদা।
এক কাপড়ে বছর পার করতিস মা তুই।
বুঝেছি ছাড়া আঁচলের তলে কত সুখ;
বুঝিনি তার নিচে ছেঁড়া-ফাটা বুকে-
কত কষ্ট তোর মা!
তোর মলিন হাসি দেখেও বুঝিনি তুই ত্যাগী।
আমি সেদিনও স্বার্থপরই ছিলাম।


কলেজে পড়াতে তিলে তিলে জমানো কৌটার পুঁজি,
গাভীন ছাগীটার বিক্রির টাকা,সব উজাড় করেছিস।
এর,ওর কাছে সাহায্য চেয়ে,
ছোট হয়ে আমাকে বড় করেছিস।
কিন্তু তুই জানতিস না মা,
আমি সেদিনও স্বার্থপর ছিলাম।।


মনে পড়ে মা,তোর চিরশত্রু-
কথায় কথায় তোকে-
খোটা গালাগাল দিয়ে বেড়াতো;
পাশের বাড়ির স্টার জলসার,দজ্জাল মহিলা'র,
ঝগড়াটে মেয়েকে ঘরে এনেছিলাম-
তোর অমতে।
তোকে তো পাত্তাই দেয়নি।
সেদিনও বুঝিস নি,স্বার্থপরেরা এমনি হয়।


বউয়ের কথায় তোকে অবহেলা করেছি,
কটু কথার তীর মেরেছি,
গায়ে হাত দেই নি সমাজের ভয়ে।
স্বার্থপর হলে কি হবে, সমাজ তো মানি?
সমাজ আমাকে স্বার্থপর ভেবেছি ঠিকই;
তুই কেন না মা?


অবশেষে তোকে ফেলে,
শহরে এসেছি আমরা নবদম্পতি-
কেউ আমাকে গর্ভে ধরেছিল-
ভুলেই গিয়েছি।
তবুও তুই দোয়া করেছিস,
স্বার্থপররা যেন আরো বড় হয়।


আজ তুই শয্যাশায়ী,
কেউ দেখবে না তোকে।
কাল তুই হয়তো চলে যাবি,
কেউ কিছু দেবে না তোকে
সাদা কাপড়,সাড়ে তিন হাত মাটি?
তাও স্বার্থপরেরা না-
হয়তো অন্য কেউ।


কিন্তু কেন,কেন?
চিৎকার করে জবাব দে মা!


সন্তান গর্ভে ধারণ করা কি পাপ?
বুকের ভালবাসায় আগলে রাখা কি পাপ?
নাকি মা মমতাময়ী হওয়া পাপ?


তবে কিসের এত যাতনা -যন্ত্রনা তোর মা?
তবুও বলবো,কেন স্বার্থপর চিনলে না মা?
যুগের পর যুগ যাবে,স্বার্থপররা তবুও থাকবে।
তবু কেউ থাকবে স্বার্থপর নয়-
বায়েজিদ বোস্তামী হয়ে।
কত নচিকেতা গান গাইবে,
কত জসীমউদ্দীন তোকে ভালবেসে-
কবিতা লিখবে।
আর ঐশীরা তার ফায়দা নিবে।


একদিন সবাইকেই এই স্বার্থপরের কবলে-
পড়তে হবে মা।
স্বার্থপরেরাও সেদিন বাদ পড়বে না;
এমনই বিলাপ করবে-
স্বার্থপর!স্বার্থপর! সব স্বার্থপর!