প্রতিদিন একটি করে চিঠি পাই,
কে পাঠায়, কোত্থেকে পাঠায় কিছুই ঠিক জানা যায় না।
ঠিকানা, নাম, টেলিফোন নাম্বার কিছুই থাকে না,
থাকবার কথাও না ওসবের কিছু,
তবু চিঠি পড়ে আন্দাজ করে নিতে হয়।


গতকাল,
বৃহস্পতিবার যে চিঠিটা পেয়েছি সেটা নির্ঘাত বাবা পাঠিয়েছিল,
লেখা ছিল, ‘খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তাইনা?
জীবনটাকে গুছিয়ে নে, তাড়াহুড়া করার কিচ্ছুটি নেই।
সময় হলে পুকুরের বৃদ্ধ মাছগুলোকে একবার দেখে যাস।’


খুব বেশিদিন আগের কথা নয়,
সাড়ে তিন কি চার বছর,
বাবা তখনো রিটায়ার্ড করেন নি।
শুক্রবার পড়ন্ত এক বিকেলে,
বাবা আর আমি একত্রে জমি মেপে ঠিক করেছিলাম পুকুরের সাইজ কতটুকু হবে,
চিংড়ি মাছের বক্সার কতটুকু হবে, নালা ও পাড়ের উচ্চতা কত ফুট রাখা যাবে!
সত্যি বলতে মাছ চাষের প্লানটা আমারই ছিল,
আমি তো প্লান বুঝিয়ে দিয়েই চম্পট, চলে আসি শহরে।
লেবারদের নিয়ে খাটুনিটা বাবাই করেছে।
তাই চিঠিতে যখন মাছের কথা উল্লেখ থাকে বুঝতে পারি,
নিজ হাতে চাষ করা মাছ প্লেটে নেবার মত মানুষ বাবা এখনো হয়ে উঠতে পারেন নি।
বেচারা বাবা, সারাটা জীবন চিনির বলদের মত শুধু খেঁটেই গেলেন।


তার আগের দিন, বুধবারের চিঠি।
এই চিঠিটার ধরনটা একেবারেই নতুন।
শুরুটা এভাবে,
"বেশি কথা বলা যাবে না, অনেক মেরেছিস এবার শোধ দে, নইলে জানে খতম।
নাম নাম্বার সব জানা আছে, কুড়ি হাজার টাকা চাই, আর্জেন্ট!’


এমন আর্জেন্ট ছিনতাইকারী কে হতে পারে?
ভাবতে বসে যাই!
কার কার কথা না ভাবি!
ছোট বেলার স্কুলের বন্ধু সবুজ? ওকে তো অনেক মারতাম!
বেচারা আমার হাতেই মার খেয়ে খেয়েই অসুখ বাঁধিয়েছিল, ফাইনালটাই দিতে পারল না!
শেষে ওর বাবার বদলিটা হল বলে রক্ষা পেল।
কিন্তু ওর নাম্বার তো আমি আর জানি না।
তাহলে? কে? অনেক মেরেছি আমি? শোধ দিতে হবে? নাম নাম্বার সবকিছুই জানি?
কে হতে পারে এই অদ্ভুত চাঁদাবাজ?
চিঠিটা ড্রয়ারে রেখে দেই, বাতিটা নিভিয়ে শুতে যাই।
ঘুম আসে না, চাঁদাবাজের ভয়ে যেন গলা শুকিয়ে আসে।
চাঁদাবাজ, রংবাজ, এসব কারা?
হঠাৎ মনে পড়ে, ছোট ভাই জনির কথা,
জনিকেও তো অনেক মেরেছি, এখনো মারি দেখা হলেই, সুযোগ পেলেই।
আজকাল অবশ্য ইদ পূজা ছাড়া দুই ভাইয়ে দেখাই হয় না মারা তো দূরের কথা।
নিশ্চিত হলাম, এটা জনিটার কাজ!
আগে ছিল ছিঁচকে চোর!
টাকা নিত পকেট থেকে, মানিব্যাগ থেকে।
এখন বড় হয়ে চাঁদাবাজ সেজেছে! দিনে দিনে উন্নতি হয়েছে!


মঙ্গলবার,
"মঙ্গলীয় আশীর্বাদ,
শুদ্ধ কপালে রাজটিকা ভাস্বর, ভবিতব্য ভবিষ্যৎ অতীব উজ্জ্বল,
প্রত্যুষে দেখিবে খুলিবে ভাগ্য,
অতএব, দ্বিপ্রহরে নো মোর চাওমিন।’


ওরে বাবা!একদম পামিস্ট! আমার ভবিষ্যৎ লিখে পাঠিয়েছে!
যাক ধরতে পেরেছি কে এটা!
কলিগ, মঞ্জুর ভাই।
কদিন ধরেই বসকে খোঁচাচ্ছিল প্রমোশনের জন্য।
নিজের নয় আমারটার জন্য,
লাঞ্চে যে আমি চাওমিন খাই সেটা একমাত্র মঞ্জুর ভাই জানে,
প্রমোশনের অনিশ্চিত উত্তেজনায় ঘুম আসবে না সুনিশ্চিত!


সোমবার,
"শালাবাবু, কুইক শহর ছেড়ে পালাও।
তোমার আপার এবারের পছন্দ করা মেয়েটি আমার বউয়ের থেকেও জাঁদরেল,
প্রাণ বাঁচাতে চাইলে আত্মগোপন করো, ছদ্মবেশ ধরো যা ইচ্ছে করো কিন্তু ধরা দিও না।’


দুলাভাই, অত্যন্ত রসিক।
তার ধারনা আমার বোনকে বিয়ে করে তিনি বি আই ডাব্লিউ টি এর অনেক উপকার করেছেন,
আপাকে বিয়ে করে তিনি যে পরিমাণ মাটি খেয়েছেন তাতেই নাকি গোমতী নদীর নাব্যতারক্ষা হয়েছে।


চিঠির ভাষাই বলে দিচ্ছে দুর্যোগ আসন্ন,
সকল নৌযানকে ১১ নাম্বার মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হচ্ছে।
স্যুটকেস নিয়েই পালাতে হবে, বেশ কদিনের জন্যই।
আপার হাতের নাগালে এসে গেলে ক্যাঁক করে ধরবে আর বিয়ে করিয়ে দিবে তার বিদুষী নন্দাই এর সাথে!



রবিবার,
বেঁচে আছি না মরে গেছি সে খবরটা তো অন্ততপক্ষে নেয় মানুষ!
ডায়াবেটিস বেড়েছে কিছুটা, ট্রেডমিলে হাঁটা এই বয়সে সম্ভব না।
রোজ এত ট্যাবলেট খেতে কারও ভাল লাগে?
মরে গেলে এসে মাটি দিয়ে যাস।


হ্যাঁ রে খোকা,
এবারে ঈদের ছুটিটা একটু বাড়িয়ে আনিস,
ছোটবেলায় কত স্কুল কামাই দিয়েছিস আর দুই-একদিন অফিস কামাই দিলে কি এমন হয়?


এটা মায়ের চিঠি।


শনিবার,
‘মি: হাতেম তাই,
কাল ঠিক নটা। এক ন্যানো সেকেন্ডও যেন এদিকওদিক না হয়।
জঞ্জাল সাফ করে ভদ্র হয়ে আসবেন।
আজ রাত থেকে নো স্মোকিং,
আমি যদি সিগারেটের গন্ধ পাই তবে খুন করেই ফেলব
নীল শার্ট + কালো প্যান্ট সাথে লোফার।
রিডিং গ্লাসটা কাল না পড়লেও চলবে, চোখে যেন ঘুমঘুম না থাকে।
আর হ্যাঁ, অবশ্যই চুল বাম দিকে সিঁথি করে আসবেন
এসবের নড়চড় হলে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলব।
মনে থাকে যেন, সকাল নটা।’


বুঝতে আর বাকী নেই, এটা ঝিলমিল।
এই চিঠি পাওয়ার পরে আয়না, তেল, চিরুনি, রেজর ব্লেড, ব্রাশ এসব নিয়ে বসে যেতে হয়।
শুধুশুধু গৃহযুদ্ধ ! নৈবচ নৈবচ !


শুক্রবার,
এদিন চিঠি আসে না, যায়।
এইদিনে আমি এদের সবাইকে চিঠির উত্তর দেই,
কিন্তু কি লিখি তা জানি না।
কখনো কখনো দুইএক শব্দ লিখে পাঠাই,
কিংবা মাঝেমধ্যে সাদা কাগজটাই ডাকে পাঠিয়ে দেই।
এত ভালবাসার উত্তরে কি লিখতে হয় ঠিক জানা নেই,
চিঠির প্রতিউত্তরে এদেরকে কি লিখব আমি?
এর থেকে ভাল হয়,
কাগজের পাতাগুলো উড়ে যাক শীতের ঝরা পাতার মত,
কলমের কালিটুকু ক্ষয়ে যাক উবে যাওয়া কর্পূরের মত।