জীবন এক আপসহীন লড়াই! আর লড়াই লড়তে চাই প্রতিপক্ষ! ইচ্ছে মতো প্রতিদিনই  বাইরে থেকে নতুন নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজে নিই, সে ধর্ম, বর্ণ, জাত, ধনী-গরীব যাই হোক না কেন! প্রতিদ্বন্দিতাই জীবন! অ্যাড্রিনালিন এর তীব্র ঝাকুনি না পেলে জীবনটা কেমন যেন পানসে হয়ে আসে! অথচ মানুষের সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ কিন্তু তার নিজের মধ্যেই থাকে, সে আর কেউ নয় সে স্বয়ং খিদা! যতক্ষণ পেট ভরা থাকে ততক্ষণ সে লড়াই এর রসদ যোগায়! আর যখন সে পেটের ভেতরে চাগাড় দিয়ে ওঠে, তখন সবার সঙ্গে আপোস করে নিজের সঙ্গে লড়তে শেখায়!
এই অনুভবে আজকের কবিতা “প্রতিপক্ষ”--


অন্ধকারে চুপটি করে ছোট্ট কুঠুরি-
আট ফুট বাই দশ ফুট তার একটু বাউন্ডারি।
কার যেন কি খেয়াল হলো, খেলবে খেলা এমনতর-
ঘোর লাগবে, ভিরমি খাবে, চমকে যাবে দারু্নতরো!  
দুই ব্যাটাকে ধরে আনে, দুটোকেই আজ বাজিয়ে দ্যাখে
দুজনেরই কলজে বড়, দুজনেতেই লড়তে দড়!


মোহন্ত দাস, মহিউদ্দিন বসে ঘরের কোণে-  
চোখপাকিয়ে তাকিয়ে দুজন, দুজনেরই পানে।
এ যেন এক আখড়ার মাঠ, কুস্তি লড়াই হবে-  
পেশাদার দুই প্রতিপক্ষ, দুজনেরই মুখটা গুঁড়িয়ে দেবে।
হাতের গুলি পাকিয়ে বসে, লুঙ্গি ধুতি বেঁধে কোশে
হাড় জ্বালানো ফিচেল হেসে, তাকায় দুজন দারুন রোষে।


শুধু ঘন্টি যদি বাজে, কেউ রবেনা বেঁচে-
ভাঙবে মাজা, ভাঙবে কোমর, মুণ্ড দেবে ছেঁচে।    
খানিক পরে ধীরে ধীরে, মেজাজ যখন শান্ত হল-  
পেটের ভিতর তবলা বাজে, খিদার ইঁদুর খামচে দিলো।
সেই যেন কোন ভরদুপুরে কোপ্তা পোলাও খেয়েছিল,
তারপরে তে লবডঙ্কা, খিদার চোটে মনের ভুলে
জিভের ডগা, নিজেই নিজের কামড়ে দিলে।  
  
কেউ কি জানে দিন কি না রাত? এখন কটা বাজে?
কেউ কি আছে জেগে কোথাও? কেউ কি দেবে খেতে?
সব পড়শী ঘুমিয়ে বোধহয়, শুধু কাক পক্ষী জেগে-  
মন্দ কপাল, ভাত বুঝি আর জুটবে না আজ রাতে।
কাহার যেন কোমল হৃদয়, একটু খানি সদয় হল-
আড়াল হতে নীরবে সে, এক থালা ভাত বাড়িয়ে দিলো।


খাবার দেখে, দুজন মিলেই দারুন বেগে হামলে পড়ে-
অশ্রু চোখে, বিহ্বল ভাবে! দুজনেই তা ছুঁয়ে দিলো-  
মুখ দুজনের মলিন হল, ভাতের থালা ব্রাত্য হল।
পেটের খিদা পেটেই রেখে কোনক্রমে রাতটা কাটে।
পরের বারে খাবার এলে, মোহন্ত দাস ফায়দা লোটে-  
ভাত যতটা পারে খেতে, খেলো সে তা মনের সুখে-  
বাদ-বাকিটার এলা-প্যালা, দিনের শেষে গেলো ফেলা।
মহিউদ্দিন খলি পেটে, গুমরে মরে দারুন রোখে।
                        
পরের দিনে উল্টো ঘটে, মহিউদ্দিনের ভাত ভাগ্যে জোটে।
মোহন্ত দাস ডিগবাজি যায়, মহিউদ্দিন পেট ভরে খায়।
এতক্ষণে বুঝল দুজন খালি পেটের মহান বিপদ!  
অতঃপরে রফা হল, ভাত এলে আর কাড়াকাড়ি না-
দুজন মিলেই ভাগাভাগি- দুজন আধা-আধি খাবে!
এবার যখন থালা এলো, মাঝামাঝি বর্ডার হলো-
এমনি তো সব ঠিকই ছিল, তবে ছোট্ট থালা-
অনেকটা ভাত ছড়িয়ে পড়ে নষ্ট হল।


দিন দুবেলা মাগ্‌গিগণ্ডা, অপচয়ের নেই ভরসা!  
প্রাণ রাখি না মান! তাই কষ্ট হলেও একটু খানি এগিয়ে আসা!
এবার থেকে এই অভাগা ভাগা ভাগি বাতিল।
পরের বারে একই থালায় একই সঙ্গে খাওয়া-    
বুকের ওপর পাষাণ রেখে, গুঁড়িয়ে দিল পাঁচিল।  
বাঁচলে প্রাণে যাত হুজ্জত পরেও যাবে করা।
বাঁচার জন্য খাবার লাগে, পেট যেন রয় ভরা।

পেট পুরে ভাত খাবার পরে, ভক্তি জাগে সবার মনে-
মোহন্ত দাস পরম ভক্ত, মন ভক্তি গদগদ!
তার হাতের ছোঁয়ায় দেয়াল জুড়ে স্বয়ং ঋদ্ধি সমাগত।  
তারপর তাঁর ধ্যানগম্ভীর পূজায়  অপার শান্তি!
মহিউদ্দিন নামাজ পড়লেন, মুদ্রিত চোখ, বক্ষে প্রশান্তি।
হাঁটুর ওপরে উপবিষ্ট, প্রশান্ত তাঁর ললাট!
বন্ধ ঘরের খুলল কপাট, এলেন গৃহস্বামী
তিনিই আদি, তিনিই আদ্যা, তিনিই অন্তর্যামী।
    
দুনিয়াদারির মালিক তিনি, তাঁর চোখের কোলে জল-  
চিকন চিকন আনন্দাশ্রু ঝরছে অবিরল।  
ঠোঁটের কোনায় জেগে হাসি তাঁর ভুবন ভোলানো-  
হাতে বরাভয়! বিস্ময়াভিভূত! যেন স্বপ্ন সাজানো।  
দেখলেন চেয়ে, তাঁর ভক্ত দুজন, ভক্তি অনুপম-
মূর্তির আগে হাঁটু গেড়ে প্রণিপাত- আর বিমুর্তের ইবাদত—
অমিলের চেয়ে মিল বেশি তাতে, ভঙ্গিটা একই রকম!
নির্নিমেষে ছুঁয়ে দিলে দুজনের বুকের বামা দিক-
যেথায় ঘুমিয়ে অকাতরে বিশ্ব প্রানের অনন্ত প্রদীপ।


কানের ভেতরে দিলেন মন্ত্রগুপ্তি--
হৃদয়কে করো প্রসারিত বন্ধু, প্রশান্তি ছেয়ে থাক হৃদয় জুড়ে-
ভালোবেসে তো দেখো সখা, অবিমিশ্র প্রেমে হৃদয় দেবে সে ভোরে।।