১। মায়ের শাড়ির পাড়ে বাঁধা আকাশ
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
-------------------------------
রাতের শেষ জানালায় একফোঁটা নীল চোখ
সেই চোখে মা স্বপ্ন দেখে
যেখানে ঘুমেরা পাখির ডানা হয়।
মায়ের শাড়ির পাড়ে বাঁধা ছিল একটা আকাশের
মানচিত্র... আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে
ধুলোর মধ্যে খুঁজছিলাম মহান সৃষ্টিকর্তার হাত।
মা তখন একটা বালিশের নিচে রেখে দিলেন পৃথিবী
বললেন, এইটুকু মাটি, বুকের পাশে রাখিস
যদি কখনো সময় পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
মা হয়ত জানেন না...
তাঁর কণ্ঠস্বর এখন ঘুমহীন ঘরের ঘড়িতে লুকায়
আর চুলের গন্ধে লেগে থাকে অচেনা কোনো জন্ম।
কখনো তিনি জলের শরীরে হেঁটে আসেন
কখনো শুধু নিঃশ্বাস হয়ে
আমার বুকের ভিতরে একটা পাহাড় হয়ে দাঁড়ান।
আমি জানি না, পৃথিবীর সব মা আসলে কতটা মানুষ
না কি তারা একজন মহান স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি?
২.মাটির শব্দে মা
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
মায়ের কণ্ঠ ছিল মাটির মতোন
বৃষ্টির নিচে ভেজা কোনো গহীন স্তর
যেখানে শব্দ জন্ম নিতো আগুন ছুঁয়ে
যেখানে প্রতিটি ডাকে একটি জীবন পল্লবিত হতো।
তিনি কথা বলতেন যখন
আকাশ একটু নিচে নেমে আসত
আর আমি—একটি অনভিপ্রেত বীজ
তাঁর চরণের ধুলোয় শিকড় ছড়াতাম।
মায়ের হাঁটার শব্দ ছিল শস্যের সুরে বাঁধা
আমি প্রতিটি পায়ের ছাপ গুনে বুঝতাম
ভবিষ্যতের আবহাওয়া।
তাঁর স্পর্শে সময় থেমে যেত
নাকি সময়-ই তাঁকে আঁকড়ে ধরে বাঁচত
তা বুঝতাম না কখনও।
তিনি বলতেন, তুই নদী হবি একদিন
তোর কান্না দিয়ে গড়া হবে পাথরের ভাষা।
৩. আয়নার পেছনে মা
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়াই
কিন্তু যে মুখ দেখি, তা আমার নয়
তা এক জগত মায়ের মুখ
যার গালদুটো মায়ের কোলের মতোই শান্ত
আর চোখে জমে থাকে কালচে জোনাকিরা।
মা আয়নার উল্টোদিকে থাকেন
এক ফালি আলোর নিচে
যেখানে সময় পেছনে হাঁটে
আর আত্মার ঘুম ভেঙে যায় ছায়ার ঘর্ষণে।
আমি আয়নার কাঁচে আঙুল রাখি
তিনি সরে যান ধীরে
তারপর তাঁর নিঃশব্দ ঠোঁট
একটি ভাষা জন্ম দেয়
যা কোনো মানুষের জানা নেই।
প্রতিদিন আমি একটানা মুখ খুলে থাকি
এই আশায়
মা হয়তো একদিন নিজের নামে আমাকে ডাকবেন
একটি সেই নাম, যা কেবল গর্ভ জানে।
৪. স্বপ্নের গর্ভে মা
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
এক রাতে, স্বপ্নের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো মা
চোখে তার ঘুমভাঙা চাঁদের রেখা
হাঁটছেন উল্টো দিকে, সময়ের শেকড় ধরে
যেখানে জন্ম আর মৃত্যু গুলিয়ে যায়।
তিনি তখন কথা বলছিলেন পাখিদের ভাষায়
যার প্রতিটি ধ্বনি রূপ নিতো ছাইয়ের ফুলে।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,
তুমি কি এখনো আমার মা?
তিনি হেসে বললেন, তুই যে স্বপ্ন দেখিস,
সেটাই আমার গর্ভ।”
আমি তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখি
একটি শিশুর কান্না জলে গলে যাচ্ছে, আর মা
আলোর রেখায় গাঁথা হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন
আমার চোখের গভীরতম নিঃসঙ্গে।
৫। অনুপস্থিতির শরীরে মা
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
ঘরজুড়ে মায়ের না-থাকা ছড়িয়ে আছে
বাতাসের চুলে, দেয়ালের নিঃশ্বাসে
একটা বালিশ এখনো তাঁর ঘ্রাণে ভারী
একটা চুল ধীরে পড়ে দিনের শেষে
সেই চুলে জড়িয়ে থাকে জন্মের গল্প।
তাঁর শাড়ির খুঁটে আজো বাতাস কাঁদে
তাঁর হেঁটে যাওয়া পথ এখনো শব্দ ধরে রাখে
যেমন ধুলোর মধ্যেও কিছু গন্ধ থাকে বৃষ্টির আগেই।
আমরা ভুলে যাই তাঁকে
তাঁর নামটি রাখি স্মৃতির ড্রয়ারে
তবু তিনি ফিরে আসেন চুপিচুপি, কোনো অপরাহ্ণে
হঠাৎ এক চায়ের কাপ
বা থালার পাশে কোনো অনুচ্চ উচ্চারণে।
৬। চিরন্তনের আঙুলে মা
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
-------------------------------
মা এখন আর কেবল রক্ত-মাংস নন,
তিনি এক মহাকাশ
যেখানে প্রতিটি গ্রহ তাঁর স্তনের মতো
জন্ম দেয় আলো।
তাঁর গলায় গাঁথা থাকে রাতের শঙ্খ
যাতে শুনি আমি
আত্মার না-বলা প্রার্থনাগুলো।
আমি হাঁটি একা
তবু তাঁর আশীর্বাদ আমাকে ঘিরে থাকে
অদৃশ্য কুয়াশার মতো।
তাঁর গন্ধ নেই, মুখ নেই
তবু আমি কোথাও গিয়ে যখন কাঁদি
তিনি জল হয়ে ওঠেন আমার চোখে।
মা তুমি কি মহান স্রষ্টার প্রথম খসড়া
যার ভুলরেখাগুলো আমাদের কপালে টিকে যায়
ভালবাসা নামে?