==================================


ছেলে বেলায় নৌকা করে মাঝ বিলে,
শাপলা তুলতে খুব ভালো লাগতো |
কি অপূর্ব সৃষ্টি,
স্বচ্ছ স্ফটিকের সবুজ বিছানায় মেলে ধরা শুভ্র পাপড়ি |
পানিতে আমার খুব ভয়
ছোট মামার সঙ্গী হতাম সব সময় |
মামা,শাপলা তোলার নগণ্য কাজটি তুলে রাখতেন আমার জন্য  |
তিনি লম্বা ডুব দিয়ে শালুক তুলে আনতেন  |
বাড়িতে শালুকের খুব সমাদর |
উনুনে শালুক সিদ্ধ হতো,
উঠোনে সবাই অপেক্ষা করতো শালুকের স্বাদ নেয়ার জন্য |
আর আমার তোলা শাপলা গুলো,
অনাদরে, অবহেলায় রান্না ঘরের এক কোনায় পরে থাকতো |
খুব কষ্ট পেতাম, ভাবতাম,
আর শাপলা তুলবো না  |
শালুক তুলবো |
কিন্তু আমার সাহস হতো না |
এখন আমি খুব ভালো সাঁতার পারি,
লম্বা ডুব দিতে পারি,
মালদ্বীপের স্ফটিক জলে স্নোরিং করি ,
কখনো কখনো সমুদ্র তল থেকে মুক্তো তুলে আনি,
কিন্তু,
ছেলেবেলার সেই শালুক তুলতে না পারার কষ্ট আমি ভুলতে পারি নি |


বাড়ি থেকে আমার স্কুল বেশ দূরে ছিল |
হেটে গেলে প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় লাগতো |
আমি প্রতিদিন বই এর বোঝা কাঁধে নিয়ে,
ছোট ছোট পায়ে হেটে যেতাম |
আমার বন্ধু রা রিকশা করে যেতো |
রিকশায় আমাকে অতিক্রম করার সময় ,
আমার দিকে তাকিয়ে করুণা করতো |
আমি তাদের উপেক্ষা করার প্রানপন চেষ্টা করতাম |
আমার ও খুব রিকশা করে স্কুলে যেতে ইচ্ছে হতো |
কিন্তু সংসারে টানাটানি, বাবার রক্তচক্ষু আর
মা'র বেদনা ক্লিষ্ট ঘর্মাক্ত মুখ দেখে,
আমি আমার ইচ্ছে র কথা কোনোদিন বলতে পারিনি |
আমি এখন প্রাডো তে চড়ি,
ইচ্ছে করলে মার্সেডিজ, ক্যাডিলাক কিংবা রোলেস রয়েস কিনতে পারি  |
আমার সেই বন্ধু রা কিন্তু এখনো রিকশাতেই চড়ে |
আমাকে দেখলেই ছুটে আসে,
শ্রদ্ধা ভরে তাকিয়ে থাকে,
আমি তাদের বিনম্র দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যাই |
আমি যে তাদের মতো,
রিকশায় চড়ে স্কুলে এ যেতে পারি নি |


আমার বন্ধু, পাশের বাড়ি ,
সবসময় আমার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতো  |
আমার রিপোর্ট কার্ড হাতে পাওয়ার আগেই ,
বাড়িতে মিষ্টি পৌঁছে যেতো  |
আমি আমার মা'কে কোনোদিন,
পাশের বাড়িতে মিষ্টি পাঠানো র উপলক্ষ করে দিতে পারিনি |
মা'র সে বেদনা ক্লিষ্ট , পরাজিত, বিমর্ষ মূর্তি র সামনে
আমি ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম,
আমার অক্ষমতা মা'র চোখ থেকে কেমন মমতা হয়ে ঝড়ে পড়তো |
এরপর অনেক পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়েছি ,
অক্সফোর্ড আর হার্ভার্ড এ শিক্ষকতা করেছি ,
আমার গবেষণা পত্র এখন অনেক নামি দামি ইউনিভারসিটি র  পাঠ্য |
কিন্তু মা’র সে অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার অক্ষমতা,
আজও কষ্ট হয়ে জমে আছে বুকে ,
আমি তো মা’কে কখনো জয়ী করতে পারি নি |


এমন অনেক অপূর্ণতা ই পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল |
বড় কাকার আয়েশি ভঙ্গি তে ক্যাপেস্টেনে আগুন দেয়া আর
মাতাল করা সিগারেটের গন্ধে ভাবতাম,
বড় হয়ে আমি শুধু ক্যাপেস্টেন খাবো |
এখন বেনসন, কেন্ট, ডেভিডফ আর মার্লবোরোর ভিড়ে
শুধু ক্যাপেস্টেন খুঁজে বেড়াই |
কাঁচের চুড়ি ভেঙে একদিন মার হাত রক্তাক্ত হলো |
আমি বলেছিলাম,
বড় হই | সোনার চুড়ি তে তোমার হাত ভরে দেবো |
দফাদার কাকু কে বলেছিলাম বড় একটা বন্দুক কিনে দেবো |
বাবাকে একটি রোলেক্স ঘড়ি,
কিংবা গলি র মোড়ে র ভিখিরি
যে কিনা একটা ভাঙা চশমা কোনো মতে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখতো ,
আমি তাকে একটা চশমা কিনে দিতে চেয়েছিলাম |
মাস্টার মশাই কে একটা স্কুল কিনে দিতে চেয়েছিলাম |
পাশের বাড়ির বেণী দুলানো কিশোরী কে বলেছিলাম
বড় হই, তোর বর হয়ে আসবো, দেখিস ?


আমি এখন অনেক বড় হয়েছি,
বাড়ি, গাড়ি, ঐশ্বর্য আর ক্ষমতায় আকাশ ছুঁয়েছি |
এখন ইচ্ছে করলেই সব পারি,
দিনকে রাত আর রাত কে দিন |
শুধু আমার অপূর্ণ সাধ গুলো পূর্ণ করতে পারি না |
আমার অপূর্ণতা গুলো যে কখনো পূর্ণ হবার নয় |
অপূর্ণ সাধে ই শৃঙ্খলাবদ্ধ আমার পূর্ণ জীবন |


========================================