এই পৃথিবীতে জন্ম নেবার পর আমাদের সকলেরই একটা শিশুকাল থাকে । গ্রামে, শহরে, আধাশহরে, মহানগরে আত্মীয়জন পরিবৃত হয়ে আমরা বড়ো হতে থাকি । শিক্ষা পেয়ে, না পেয়ে, অর্ধশিক্ষিত হয়ে আমরা বড়ো হয়ে উঠি । বড়ো হয়ে ওঠার পথে নানান অভিজ্ঞতা ও নানা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয় । আনন্দ পেলে আমরা হাসি । দুঃখ পেলে কাঁদি । ভালো কাজ করলে প্রশংসা পাই । দুষ্টুমি করলে বকুনি খাই । কখনও অবাক হই । ভয় পাই কখনও । এর মধ্যে হঠাৎ একটা সময় থেকে আমাদের একটা অংশকে কবিতাভাবনা পেয়ে বসে । কাগজ কলমে আঁকিবুকি শুরু হয় । এখন হয়েছে মোবাইল বা কম্পিউটার । সেখানেই শব্দ নিয়ে খেলা শুরু হয় । প্রথমে শব্দগুলো বশে আসতে চায় না । বড্ড দুষ্টু,  কিছুতেই পোষ মানে না। কখনো অক্ষর আর শব্দেরা আপন মনে খেলতে থাকে । ফুটে ওঠে নানা দৃশ্যপটের অপার্থিব শব্দরূপ। সেটাই হয়ে ওঠে কবিতা ।
বেড়ে ওঠার পথে যতো সব অভিজ্ঞতা, সে সবই হয় কবিতাগুলির আশ্রয় । কবিতার উপাদান । উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিছু ক্ষমতা, বা স্বোপার্জিত - সমাজ, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম এগুলির সঙ্গে বাস করার সূত্রে কিছু কিছু অর্জন - এই সব কিছুই কবিতায় চলে আসে । তার সঙ্গে যোগ হয় কল্পনা । কিছু রোমান্টিক ভাবনা । যার যেমন কল্পনার জোর, তার রচনার তেমন ধার ।


কবিতা তো লিখি । কিন্তু সে কবিতা পড়ে কে । একটা কথা বলা হয় এখন কবিতা পাঠকের চেয়ে কবিতা লেখকের সংখ্যা বেশি । তা হোক । তবু কবিতা লেখা হচ্ছে এবং হবে । হাজার বছর ধরে হয়েছে, নতুন কবি এসেছেন, লিখেছেন, কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন কেউ। কেউ আবার রয়ে গেছেন চিরকালের প্রাসঙ্গিক হয়ে ।


এত যে সব কবিতা লেখা হচ্ছে তার মধ্যে ভালো কবিতা কোন্ গুলি, আর কোন্ গুলি খারাপ কবিতা - সে প্রশ্ন উঠছে । এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে ভাল কবিতা বা খারাপ কবিতা বলে কিছু থাকতে পারে না। আসল কথা হলো রচনাটি কবিতা হয়েছে কিনা ? লেখাটি যদি সত্যি কবিতা হয়, তবে তা ভালো কবিতা । আর যা কবিতা হয় নি তা খারাপ কবিতাও নয় । তাই ভালো কবিতা ও খারাপ কবিতা বলে আলাদা করে বিশেষায়িত করবার কোনো মানে হয় না । যে লেখা কবিতা, তা এমনিতেই ভালো ।


কবিতার কবিতা হয়ে ওঠার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ন হলো রচয়িতার নিজে কবি হয়ে ওঠা। এ জন্যে দরকার কবিতার ভাষা, ভাব, ছন্দ ও কবিতার বিবর্তন সম্বন্ধে ধারনা। তার সঙ্গে  নিজের কাল, দেশ, সমাজ, রাজনীতি, জনরুচি, বিষয় ও আঙ্গিকগত ধারণা ।


আমাদের এই ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা সহ অন্য বহু ভাষার জন্ম হয়েছে বলে ধারণা করা হয় । বাংলা সাহিত্যের বিস্তারে সংস্কৃত সাহিত্যের অবদান সর্বজনস্বীকৃত । সংস্কৃত ভাষার আদি কবি হলেন ঋষি বাল্মিকী। দেবতার আশীর্বাদে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন বলে বিশ্বাস। দুটি মিলনরত ক্রৌঞ্চ বা সারস পাখির একটিকে এক শিকারি শরবিদ্ধ করে মেরে ফেলে । নদীতে স্নান করা অবস্থায় বাল্মীকি মুনি সেই দৃশ্য দেখেন । শোকে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি উচ্চারণ করেন-


’মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম: শাশ্বতী: সমা:
যত ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধী: কামমোহিতম’


এই শ্লোকটিই ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রথম কাব্য। তার সূত্র ধরেই রামায়ণ মহাকাব্যের সৃষ্টি বলে বিশ্বাস । বাল্মীকি ও তার সমসাময়িক কবিদের কবিতা ছিল মুখে মুখে রচিত। মহাকাব্যে বীরত্বের বর্ণনাই ছিলো মূল রীতি। দীর্ঘদিন চলেছে এই চর্চা। তারপরে আসে বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চার আদি নিদর্শন চর্যাগীতির সময়। এ সময়ের বাংলা কাব্যগুলো মূলত ছিল গান এবং তার রচয়িতা বৌদ্ধ সহজিয়াবৃন্দ।
মধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, পালা ও পুথির চর্চায় বাংলা ভাষার ভিত্তি শক্ত হয়। এ সময়ের বাংলায় অন্ত্যমিল ও ছন্দবদ্ধতাই ছিল মূল বিষয়। যে কারনে প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা ভাষার কবিতাকে মূলত পদ্য বলে অভিহিত করা হত।


আধুনিক বাংলা কবিতার জন্ম মধুকবির হাত ধরে যিনি ইউরোপীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। বলা চলে বাংলা কবিতার খোলনলচে বদলাতে ইউরোপীয় ভাবধারার কবিরাই মূল ভূমিকা পালন করেছেন। মধুসূদন দত্তও মহাকাব্য লিখলেন । কিন্তু তিনি লিখলেন আধুনিক অমিত্রাক্ষর ছন্দে । চরণান্তিক অন্ত্যমিলের বাইরেও যে কবিতা লেখা হতে পারে তার উদাহরন রাখলেন মাইকেল । বেশ কিছুদিন চললো মহাকাব্যের যুগ।
এলেন রবীন্দ্রনাথ । আকাশের রবির মতই উজ্জ্বল এক জ্যোতিষ্ক । তাঁর হাতে শুরু হলো বাংলা কবিতার রোম্যান্টিসিজমের যুগ । একক প্রতিভা প্রদর্শনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় হিসেবে চিহ্নিত থাকলো এই যুগ। কবিগুরুর কাছে কবিতা ছিল সুন্দর ও সত্যের সাধনা, আধ্যাত্মবাদের অন্তর্গত শুদ্ধতার প্রতীক। এ সময়ের শেষ ভাগে এলো দ্রোহের কবিতা। নজরুল কাব্যের দ্রোহ স্বত্বা কবিতাকে নতুন কথা বলতে শেখাল। এর পরে এলো কবিতার আধুনিক নির্মাণ ও দশকিয়া চিন্তারীতি । বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সমমনা পাণ্ডবেরা করলেন ত্রিশের দশকের প্রচলন। যদিও এই দশক বিভাজন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে । কেননা দশ বছরের মত স্বল্প সময়ে কোন ভাষাতেই কবিতার আঙ্গিক বা কাঠামো বদলের নজির সেইভাবে নেই । বিশ্ব সাহিত্যেও দশকীয় রীতির এত ব্যাপক প্রচলন আছে কিনা জানা যায় না। ইংরেজি সাহিত্যে নিও ক্লাসিক্যাল এজ, রোমান্টিক এজ, ভিক্টোরিয়ান এজ এসেছে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ।


যাই হোক, এলো ত্রিশের আধুনিকতা, ব্যক্তি ও সমাজের অসুস্থতার বয়ান। নতুন সুর,  নবীনের জয়গান । একাকীত্ব, নির্জনতাই যখন উপমা, আর উপমাই হলো কবিতা। জীবনানন্দ লিখছেন, একা হাঁটছেন কলকাতা, বরিশালের পথে । সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন কবিতায় রাজনীতির কথা । বুদ্ধদেব বসু মেতেছেন কবিতার নান্দনিকতা ও কাব্য সমালোচনায়।

সাতচল্লিশ সালে দেশভাগ । সময়টা উত্তাল । বাংলা কবিতার নতুন ঠিকানা হলো ঢাকা । আহসান হাবীব, আবুল হাসানরা লিখছেন। ষাটের দশক । আন্দোলন, গণবিক্ষোভ । এলেন একদল রাজনীতি সচেতন কবি - শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুন, হুমায়ূন আজাদ । তাঁদের কলমে দেশ, জাতি, স্বাধীনতা, নগরকেন্দ্রিক জীবনের জটিলতা এলো অদ্ভুত এক রূপ নিয়ে। এর সঙ্গে থাকলেন নান্দনিকতার কবিরা, যেমন আল মাহমুদ, আবুল হাসান, শহীদ কাদরী। তাঁরা কবিতায় এনেছেন গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য । কবিতা  প্রচলিত তিন ছন্দ ছেড়ে ধরলো গদ্যের পথ। এলো মুক্তিযুদ্ধের যুগ । জাতীয় আন্দোলনের সাথে মিশে গিয়ে কবিতা হয়ে উঠলো শ্লোগানময়। আশির ও নব্বই এর দশকে কবিতায় আবার এলো নির্জনতা । এলো পরাবাস্তবতা । কবিতায় মুক্তগদ্যের ধারা পোক্ত হলো। ছন্দ, মাত্রা বিন্যাস নিয়ে ভাবনা আগের থেকে অনেক কমে আসলো।


দেখা যায় কালের বিচারে কবিতা এমনই একটি শিল্পমাধ্যম যেখানে যুগে যুগে রচনার রীতি পাল্টে গেছে । অতীতে যে রীতির কবিতা মহৎ কবিতা হিসেবে বিবেচিত ছিল, আজ যদি সেই রীতি মেনে কেউ কবিতা লেখেন তবে তা মামুলি রচনা হিসেবে গণ্য হতে পারে। তাহলে এটাই দাঁড়ালো যে বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারাই  কবিতার অন্তিম সত্য। কবিতা মহাকালের মত সত্য, ধ্রুব ও স্থির। আর মহাকাল তাকেই কবিতা বলে বুকে টেনে নেয়, যা নিজের সময়কে তুলে ধরে, আবার কালের স্রোতে ভাসে । কবিতাকে চিনে নেবার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যুগে যুগে নতুনতর ভাবনার জন্ম হয়েছে । কবিতা কখনো উপমার প্রয়োগ, কখনো ছন্দের দোলা, কখনো ভাবের বাহন, আবার কখনো দৃশ্যকল্প বা চিত্ররূপ। আবার কখনো বিমূর্ততা । কবিতা কখনো নতুন নতুন ভঙ্গিতে জীবনের কথা বলে, কখনো প্রতিবাদের ভাষা, কখনো সুরের ধারা, কখনো বা রসসিক্ত। কবিতা কবির অন্তরের সত্য, কবির জীবনদর্শন। যে জীবনদর্শন নতুন কিছু বলে, যে বাণীগুলো আগে কখনো ছিল না, যে প্রকাশভঙ্গী স্তম্ভিত  অথবা পুলকিত করে দিতে পারে সমাজকে ।


কবি যদি সমকালীন সময়ের চর্চার সাথে সাথে দেশজ, বৈশ্বিক এবং চিরকালীন সময়কে ছুঁয়ে যান, তবেই কবিতা প্রকৃত অর্থে কবিতা হয়ে উঠে । এ কবিতা সব সময়ের, সব কালের। সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন, ধর্ম এবং সর্বোপরি মানুষ- কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ । এগুলোর যথাযথ মেলবন্ধনই কবিতার জন্ম দেয় ।


একটি কবিতা সত্যিই কবিতা হয়ে উঠলে তা অবশ্যই ভাল কবিতা । কিন্তু সব শ্রেণীর পাঠকের তা ভাল লাগবে বা সকলে সেই কবিতাকে সমানভাবে  গ্রহণ করবে এমনও নয়। এক্ষেত্রে পাঠকের স্বাধীনতা ও অভিরুচি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এমনও হতে পারে প্রকাশমাত্র পাঠক সেটি হয়তো গ্রহণ করলেন না । কিন্তু পরবর্তীতে তা গৃহীত হলো । অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটি হয়েছে । জীবনানন্দ প্রকৃষ্ট উদাহরন । মধুসূদন দত্তও তাই । এটাই কবিতার শক্তি ।


কবিতার আলোচনায় ’আধুনিকতা’ একটি চিরকালীন বিতর্কের বিষয়। বিগত দেড়শত বছর ধরে ’আধুনিকতা’ বিষয়ক তর্ক চলে আসছে বাংলা সাহিত্যে। প্রায় প্রতিটি তর্ক, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরেই কবিতাকে নতুন করে দেখার চেষ্টা করেছেন কবিরা।


সান্ধ্য-ভাষায় লেখা চর্যাপদের কবিতার যে ভাষা তা আজকের মুক্তগদ্য বাংলার থেকে অনেকটাই আলাদা । এই পার্থক্যটা একদিনে হয়নি। । আবার মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্লাসিক্যাল বাংলা থেকে আজকের বাংলা আলাদা । এই পরিবর্তনটাও একদিনে হয় নি । বিগত প্রায় দেড় শতাব্দীতে অনেক অনেকবার পাল্টে ভাষা বর্তমান জায়গায় এসেছে । এই বদলই আধুনিকতা। দেখার নতুন চোখ, জানার নতুন মন কিংবা বলার নতুন ভঙ্গিমার নামই আধুনিকতা।