বাংলার বুকে বিভাজনের  খাঁড়া প্রথমবার নেমে এসেছিল ১৯০৫ সালের ৭ই জুলাই l বৃটিশ শাসনাধীনে বাংলা দু ভাগ হয়ে গিয়েছিল l বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে কটাক্ষ করে বড়লাট লর্ড কার্জন বলেছিলেন, ""Bengal partition is a settled fact". আন্দোলনকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, " I shall unsettle the settled fact."  এবং সেটাই হয়েছিল l জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এমন তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে বৃটিশ শাসক বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১২ই ডিসেম্বর, ২০১১ সালে আর একটি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে l
কিন্ত ১৯৪৭ সালে বাংলার বিভাজনকে বন্ধ করা যায় নি l কেউ বন্ধ করার তেমন প্রয়াসও করেন নি l দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হয়ে যায় l ভারতের অংশ হয় পশ্চিমবঙ্গ এবং পাকিস্তানের অংশ হয় পূর্ববঙ্গ l দুই বাংলার মাঝে বিভেদরেখা হিসাবে সীমানা বরাবর কাঁটাতারের বেড়া বসে যায় l
১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গ নাম পরিবর্তন হয়ে হয় পূর্ব পাকিস্তান l মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলনের পরিণতিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালে পূর্ব পকিস্তান 'বাংলাদেশ' নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে l
এই হলো ওপার বাংলা এপার বাংলার গল্প l কবীর সুমনের জনপ্রিয় গানটির কথা মনে পড়ে যায় :


"ওপার বাংলা এপার বাংলা মাঝখানে কাঁটাতার
গুলি খেয়ে ঝুলে থাকলে ফেলানী বল তো দোষটা কার ?"


কবি মনিরুজ্জামান শুভ্র তাঁর "এপার ওপার" কবিতায় বঙ্গভঙ্গে বিদ্ধ এক আম বাঙালির মনোবেদনার কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন l কবি আপশোস করে বলছেন বিভেদনীতিতে বিশ্বাসী বৃটিশ শাসক লর্ড মাউন্টব্যাটনের বাংলাভাগের পেছনে যে সুদূরপ্রসারী অশুভ পরিকল্পনা ছিল, বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি মুসলমানেরা তা বুঝতে পারে নি, বোঝার চেষ্টাও করে নি l এই ভাগকে মেনে নিয়ে তাঁরা যেন এক সর্বনাশা বিপদকে চিরসঙ্গী করে নিল বঙ্গমাতার বুকের ওপর দিয়ে কাঁটা তারের বেড়া টেনে দিয়ে l গঙ্গা যমুনা পৃথক হয়ে গেল l আশ্চর্যের বিষয় ধর্মের ভিত্তিতে নদী ভাগ হলো l
ধর্ম মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তার সম্পদ, তার সাত্ত্বিক জীবনের অবলম্বন l মানুষেরই ধর্ম হয় - হিন্দু, মুসলিম হয় l হিন্দুরা বলেন রাম l মুসলিমরা বলেন রহিম l এতে তো কোনো অসুবিধা হয় না l কিন্তু প্রকৃতিকে কি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা সমীচীন ? তাহলে বঙ্গ ভাগ হলো কেন ? গঙ্গা থেকে পদ্মা পৃথক হলো কেন ? আকাশ তো কোনো ধর্মের নয় ! দূর আকাশের ঐ শঙ্খচিলের তো কোনো দেশ নাই ! তার তো কোনো ধর্ম নাই ! তারা তো মুক্ত l সব দেশের আকাশে তারা স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায় l
কবি আক্ষেপ করে বলেন ধর্মজ্ঞাপক দুটা শব্দ এক জাতিকে দুই জাতিতে পরিণত করে তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্ত দেয়াল গড়ে তুলেছে l একই সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন ইতিহাস গড়ে উঠছে l যেন ভিন্ন দুটি অঙ্গন, ভিন্ন দুটি সত্ত্বা। যেন প্রাচীন কোন জনপদের বিচ্ছিন্ন দুই মহাসড়ক।
এপার বাংলার 'মা' ডাকে সাড়া দিয়ে ওপার বাংলার কেউ সীমানা পেরুবার প্রয়াস করলে সীমান্তে গুলি চলে l কাঁটা তারের রক্তাক্ত প্রান্তরে গুলিতে ঝাঁঝরা দেহ নিথর পড়ে থাকে সীমানার পারে l
কবি বলছেন, এর থেকে বরং পাখিদের জীবনই  ভাল l ওদের কোন সীমানা নাই, ওদের কোন ধর্ম নাই, ওদের কোন জাত নাই। স্বাধীন, সার্বভৌম l কবি পাখি হয়ে বাঁচবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন l মুক্ত বিহঙ্গের মত যখন যেখানে খুশি উড়ে যেতে চান তিনি l ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন তিনি যেন কবিকে পাখি বানিয়ে দেন।


সম্প্রীতিমূলক সুন্দর কবিতার জন্য কবিকে জানাই দুই বাংলার পক্ষে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা !!!