মানবের পরিবর্তনশীল মনের চিত্রায়ন। পরিবারে এক সদস্যের মূল্যায়নে সমাজবাস্তবতা, পরিবার-বাস্তবতার রূপচিত্র।
সামাজিক নানা অনুশাসন, সংস্কার, মনের মধ্যে পুষে রাখা বিষবৃক্ষ শ্বাশুড়িমাতাকে প্রবৃত্ত করে কালো চাকুরে পুত্রবধূর সম্বন্ধে বিরূপ ধারণারাশির পাহাড় গড়ে তুলতে। সেই অনুযায়ী মনের মধ্যে যুক্তি, কুযুক্তির গাঁথুনি চলে। কিন্তু কবি সোমদেব চট্টোপাধ্যায় মানবমনের গলিঘুঁজি বিচরণ করে এক সরলমনা বাঙ্গালী শ্বাশুড়িমাতার  মনোপরিবর্তনের মনোবৈজ্ঞানিক চিত্র এঁকেছেন, একটু ভালবাসা, একটু সম্মান, একটু বস্তুপ্রাপ্তিতেই বউমা সম্বন্ধে যাঁর ধ্যানধারনাতে সদর্থক পরিবর্তন এসেছে।
যে বউমা-কে তিনি দু চক্ষের বিষ মনে করতেন, গৃহস্থালির কাজে নানাভাবে তাকে ব্যস্ত করে রাখতেন, যে বউমা-র চরিত্র সম্বন্ধেও কটুক্তিমূলক বক্তব্য তাঁর মানসে জন্ম নিয়েছে, যার সম্বন্ধে বর্ণবিদ্বেষী মানসিকতাও তাঁর ছিল, সর্বোপরি যে কালো বউমা-র আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াটাও তিনি কামনা করেছেন , এবং এইভাবে বউমা-র মৃত্যুকে বিধাতার বিধান বলেই তিনি মেনে নিচ্ছেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করছেন, কবিতার কাহিনীতে সামান্য পট পরিবর্তনেই শ্বাশুড়িমাতার এই পাহাড়প্রমাণ বিরূপ ধারনারাশি ধ্বসে পড়ে।
কবিতাটিতে তুলে ধরা হয়েছে এমন এক বাঙ্গালী শ্বাশুড়িমাতাকে যিনি অভাবদীর্ণ সংসারে নিজ কর্তব্য পালন করে গেছেন।  সন্তানেরা বড়ো হয়েছে l তাদের নিজেদের সংসার হয়েছে l যুগের পরিবর্তনে এখনকার বউমা-রা চাকুরি করছে l অর্থের মুখ দেখছে l নিজেদের ছোটখাটো শখ আল্হাদ  পূরণ করছে l বুড়ি শ্বাশুড়িমাতা বাড়িতে একা l তাঁর ভালোমন্দের কেউ খোঁজ নেয় না l তাঁরও যে কিছু ছোটখাটো চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে - একথা কারও মাথাতেই আসে না l এই যে বোধ, এর অনুভব থেকে বুড়ি শ্বাশুড়িমাতার মনের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে l সেই অসন্তোষের আগুনে তিনি নিজে অহর্নিশ দগ্ধ হতে থাকেন l ছেলেকে কিছু বলতে পারেন না l মায়েরা এমনিতেই ছেলের প্রতি দূর্বল ! তার ওপর এখানে ছেলে রোজগারহীন, বেকার l ফলে সব রাগ, অসন্তোষ, মনের জ্বালা গিয়ে পড়ে বউমা-র উপরে l যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা l অতএব বউমা-র একাধিক ত্রুটি শ্বাশুড়িমাতার নজরগোচর হয় l গজগজ করতে থাকেন তিনি l সর্বদা কামনা করেন এরকম দুশ্চরিত্রা কালো বউমা-র হাত থেকে কবে মুক্তি মেলে !
তারপর পট পরিবর্তন l বউমা-র চাকরি পাকা হয় l সঙ্গে বেতনবৃদ্ধি l এবং প্রথম উপহার আসে শ্বাশুড়িমাতার জন্য l দুহাতে সোনার চুড়িগাছা l
"কিনলাম এই সোনার চুড়ি
মায়ের আমার দু'হাত ফাঁকা !"


শ্বাশুড়িমায়ের জন্য বউমা-র অন্তরে এই অন্তঃসলিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পরিচয় পেয়ে চিরদুঃখী, চিরঅভাবী, চিরবঞ্চিতা, অভিমানী শ্বাশুড়ি মায়ের বউমা-র প্রতি সব রাগ, দ্বেষ, অসন্তোষ, অভিমান এক নিমেষে মিলিয়ে যায় l পুত্রবধূকে কন্যাস্নেহে বরণ করেন তিনি l কালো বউ আলো হয়ে ঘর সংসার উজ্জ্বল করে l
"শাশুড়ি মা থমকে দাঁড়ায়
এগিয়ে এসে দু'হাত বাড়ায়
মেয়ে আমার বড্ড ভালো
আঁধার নয় সে সত্যি আলো !"


কবিতাটিতে আছে বর্ণবিদ্বেষবাদের বিরুদ্ধে বার্তা l গায়ের কালো বা সাদা রঙ কারো মুল্য নিরূপণ করে দেয় না l মানুষের প্রকৃত মুল্য হলো তার যোগ্যতা, তার শিক্ষা, অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতা l পরিবারে নিজের প্রতিষ্ঠা, নিজের সম্মান অর্জনের প্রশ্নেও এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ - ছেলে, মেয়ে - উভয়ের ক্ষেত্রেই l


সহজ সরল কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী ঘর-পরিবারে পারস্পরিক স্নেহ, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস  - এর অভাবের চিত্র, এবং এর থেকে সৃষ্ট পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ ও অসহিষ্ণুতার সম্পর্ক l একটু ভালবাসা, একটু শ্রদ্ধা, বাড়ির বয়স্কজনদের প্রতি একটু সহমর্মিতা - অপরদিকে ছোটদের প্রতি স্নেহ, উচ্ছ্বাস, বিশ্বাসবোধ - এই জটিল সংসার আবর্তে সুখের দিশারী হতে পারে l


আটপৌরে পরিবারিক বিষয়কে আশ্রয় করে একটি সুন্দর মানবিক বার্তা দেবার প্রয়াস আছে হালকা চালে লেখা পদ্য কবিতাটিতে l


কবিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা !