পৃথিবীতে কোনো কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না । তার মূল্য দিতে হয় । এই মূল্য নগদ টাকায় হতে পারে, বা অন্য কোনো প্রকারে । আপাতদৃষ্টিতে যা বিনামূল্যে পাওয়া যায় বলে আমরা দেখি, সেখানেও আমাদের অলক্ষ্যেই জমে যায় ঋন । ঋন থেকে যায় প্রকৃতির কাছে, পিতামাতার কাছে, শিক্ষাগুরুর কাছে, এমন অগনিত শুভাকাঙ্খি বন্ধু স্বজনের কাছে । জীবনভর এই মূল্য চুকাতে চুকাতে, বা ঋণগ্রস্ত থেকে সময় আসে শেষ দিনের । এই ভবজগত ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্য জগতে । সেখানেও মাঝি থাকেন একজন । এই জগত থেকে অন্য জগতে নিয়ে যান । তরী বেয়ে বৈতরণী পার করেন । তার জন্য পারানির কড়ি লাগে । এই কড়ি অন্য কিছু নয়, জীবনভর সৎকাজ, পুন্যকর্মের সঞ্চিত পুন্যফল । সেটাও যাঁদের সঞ্চয়ে থাকে না, তাঁদের আবার সেই ঋনের আশ্রয় নিয়েই ভবজগৎ পার হতে হয় । এক জীবনের ঋন পরের জীবনে গিয়ে বর্তায় । ঋনশোধের এই চক্রজালে পড়ে ফিরে ফিরে বারবার এই ভবজগতে তাকে জন্ম নিয়ে যেতে হয় । জন্ম মৃত্যুর মায়ার এই বাঁধনে সে জড়িয়ে থাকে যতক্ষন না পর্যন্ত তার ঋনমুক্তি ঘটে ।


কবি প্রমিলা দেবী 'কড়ি' রচনায় কবিকল্পনায় ছুঁয়ে গেছেন এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও ভাবনাকে । জীবনের অন্তে তিনি উপস্থিত হয়েছেন সেই ঘাটে । তাঁর ওই পাড়ে যাবার সময় উপস্থিত । সমন পেয়েছেন । কিন্তু তাঁর কাছে পারানির কড়ি নাই । জীবনভর আত্মসর্বস্ব জীবনযাপন করেছেন । জীবিকার তাগিদে, নিজের এবং পরিজনদের প্রয়োজন মেটাতে, পার্থিব ক্ষুধা লালসা নিবৃত্তির জন্য অর্থ উপার্জন করেছেন, পরমার্থ উপার্জন হয় নি । পারানির কড়ি হিসাবে পার্থিব অর্থের কোনো মূল্য নেই । সে সব ছেড়ে যেতে হয় এই ভব জগতেই । ওপারে যায় শুধু পরমার্থ, কবির কাছে যার সন্চয় শূন্য ।
তাই অগত্যা তাঁকে আবার ঋনের আশ্রয় নিতে হয় । মাঝির কাছে প্রার্থনা রাখেন, পারানির কড়ি ছাড়াই তাঁকে ওপাড়ে নিয়ে যাবার জন্য । যেমনটা সকলের ক্ষেত্রে হয়, মাঝি সেই আবেদন মন্জুর করেন । মহানুভব মানুষের মতোই তিনি সেই তথাকথিত নিঃস্ব মানুষটিকে তাঁর তরীতে স্থান দেন এবং তাঁকে পরপারে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন । কিন্তু মাঝখানে বেড়ে যায় সেই মানুষটির ঋন । পুনর্জন্মের দাসত্ব মেনে নেন তিনি । পরবর্তী জন্মগুলিতে সেই ঋন শোধ করার দায় থেকে যায় । এই ঋন শোধ না করলে ইহজগতের দুঃখ কষ্ট জরা ব্যাধির বন্ধন থেকে তাঁর মুক্তি নাই ।
একই প্রার্থনা এবং প্রায় একই উত্তর ঘুরেফিরে পরবর্তী স্তবকগুলিতে এসেছে । নিজের ব্যথা, বেদনা, বিপদ ও অসহায়তার কথা নানা ভাষায় ও ভঙ্গিতে কবি প্রকাশ করেছেন । এবং প্রতিক্ষেত্রেই মাঝি তাঁকে সহায়তা দানের আশ্বাস দিয়েছেন । মানুষ মানুষের জন্য এই মহানুভবতার শিক্ষা দিয়েছেন । তাঁকে সাহায্য করতে পেরে মাঝি যে খুশি হয়েছেন, নিজের জীবনকে ধন্য মনে করছেন এমনও বলেছেন । দ্বিধাহীন চিত্তে তাঁর সহায়তা নেবার জন্য কবিকে আশ্বস্ত করেছেন । কিন্তু মাঝে বলে রেখেছেন সেই অমোঘ কথাটি,
  "পরে চুকিয়ে দিও
                     কাছে , নেই যখন আজ ।"


অর্থাৎ এক ঋনচক্রজালে তাঁকে আবদ্ধ করে রাখলেন । এ জন্মের ঋন পরের জন্মে, বা তার পরের জন্মে শোধ করে যেতেই হবে ।


সুন্দর ভাবনাকে ঘিরে সুলিখিত রচনাটির বিষয়ে আরো কিছু বক্তব্য আছে । প্রথমত বাংলা কবিতার স্তবক বিভাগ প্রদর্শনে ইংরাজি হরফ (1,2,3,4) ব্যবহার না করে বাংলা ব্যবহার করলেই বুঝি ভালো হতো ।
চতুর্থ পংক্তিতে "কাছে কড়ি নেই যে কোনো (কোন)


কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ।