কবি ঝুমুর বিশ্বাস একটি বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে "স্যারোগেটেড মাদার" (প্রকাশের তারিখ - ১০-০৩-২০১৯) ও "মাতৃত্ব কাঁদে" (প্রকাশের তারিখ - ১৩-০৫-২০১৯) কবিতা দুটি রচনা করেছেন l প্রথম কবিতার শিরোনামে  বিষয়টির উল্লেখ পাই এবং দ্বিতীয় কবিতার শিরোনামে পাই বিষয়টির ব্যাপক মানবিক দিকটি l  

মাত্র এক দু দিন আগে মাতৃ দিবস পেরিয়ে এলাম l সেই দিনে সকলেই নিজের মায়ের প্রতি, মাতৃ জাতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন l সত্যি বলতে মায়ের চেয়ে আপন পৃথিবীতে কোনো সম্পর্ক নেই l সন্তানের জন্য এতটা কষ্ট একজন মা - ই করতে পারেন l নিজের সুখ দুঃখের কথা চিন্তা না করে যিনি প্রতি মুহূর্তে সন্তানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ তিনি হলেন মা l গর্ভে আসার দিন থেকে মাতৃত্বের অনুভব জাগে এবং সেদিন থেকেই সন্তানের প্রতি মায়ের নিষ্ঠা ও কর্তব্যের সূত্রপাত এবং তা জারি থাকে চিরটাকাল l সন্তান বড়ো হয়ে গেলেও মায়ের স্নেহ ভালোবাসা কর্তব্য শেষ হয় না l শিশুকাল থেকে সন্তানকে কোলেপিঠে করে মানুষ করার ক্ষেত্রে মায়ের পরিশ্রম ও কষ্ট যতটা হয়, আনন্দ হয় তার থেকে শতগুণ বেশি l এবং এই আনন্দপ্রাপ্তির জন্যই সন্তান জন্ম দেয়া থেকে শুরু করে তাকে গড়েপিটে মানুষ করে তোলা প্রতিটি নারীর কাছে কাঙ্খিত l মাতৃত্বের সুখ চরম সুখ l


কিন্তু বিধাতার কি খেলা l শারীরিক কারণে কিছু নারী এই সুখ থেকে বঞ্চিত হন l স্বামীর কারণে হোক, স্ত্রীর নিজের কারণে হোক, যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান সৃষ্টির বিষয়টি শরীরের মধ্যে সংঘটিত হয়, কিছু যুগলের ক্ষেত্রে এই ব্যাকরণ কাজ করে না l উভয়ের যে কোনো একজনের অসম্পূর্ণতার কারণে সন্তানসুখ তাঁরা পান না l যে কোনো নারীর কাছে এটি অত্যন্ত বেদনার বিষয় l বলা হয় নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে l এই পূর্ণতার আস্বাদ না পাবার কারণে নারী বিষন্ন থাকেন l মনমরা হয়ে থাকেন l কখনো কখনো তাঁর নিজের জীবনটাকে অর্থহীন মনে হয় l  


কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যানে এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা হয়েছে l কোনো নারীর যদি সন্তান ধারণের ক্ষমতা না থাকে, তাহলে অন্য নারীর সাহায্যে তিনি তাঁর এই মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারেন l অন্য যে নারী তাঁকে এই সহায়তা প্রদান করবেন, তাঁকে বলা হচ্ছে স্যারোগেটেড মাদার l কৃত্রিম উপায়ে তাঁর দেহে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করা হবে l এই ভ্রুণ হবে যিনি স্যারোগেটেড মা ভাড়া নিচ্ছেন তাঁর স্বামীর দেহজাত l স্যারোগেটেড মা নয় মাস, সাড়ে নয় মাস ধরে সেই সন্তানকে তাঁর জঠরে ধারণ করবেন, তারপর সন্তানের জন্ম হলে সেই সন্তানের আসল পিতামাতার কাছে তাকে সমর্পন করবেন l সেই সন্তানের ওপর স্যারোগেটেড মায়ের কোনো দাবি থাকবে না l তিনি অর্থের বিনিময়ে এই কাজটি করবেন l নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অর্থ প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই তাঁর চুক্তি সম্পন্ন হবে এবং তিনি তাঁর নিজের জীবনে ফিরে যাবেন l নিশ্চয় যাঁরা অভাবী, অর্থের সঙ্কটে আছেন, এমন মহিলারাই স্যারোগেটেড মা হয়ে থাকেন l অর্থের বিনিময়ে তাঁরা তাঁদের মাতৃত্বকে ভাড়া দিয়ে থাকেন l টাকা হয়তো তাঁরা পেয়ে যান l কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে তাঁরা যে শারীরিক ও মানসিক অনুভব পান, কোনো অর্থরাশি দিয়ে তার পরিমাপ করা সম্ভব নয় l শরীরে সন্তানের উপস্থিতির অনুভব করেন তিনি l যেমন যেমন সন্তান বড়ো হতে থাকে, তার প্রতিটি স্তর তিনি অনুভব করেন l প্রকৃত মায়ের মতো এক নিদারুণ কষ্ট ও আনন্দ অনুভবের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় তাঁকে l কষ্টের অনুভব পূরণ হয় অর্থের বিনিময়ে যা তিনি পাচ্ছেন তাঁর জঠর ভাড়া হিসাবে l কিন্তু মাতৃত্বের যে আনন্দ তাঁর পাবার কথা, সেটা তাঁর কাছে অর্থহীন, কারণ তিনি জানেন এই সন্তানের ওপর তাঁর কোনো দাবি নাই, এটি তাঁর সন্তান নয় l প্রসব মুহূর্তেই সন্তান তাঁর হাতছাড়া হবে l প্রকৃত বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে l


অর্থের বিনিময়ে নিজের গর্ভে অন্যের সন্তান ধারণের এই যে পেশা, মনের ওপর, শরীরের ওপর তা প্রচন্ড চাপে ফেলে সেই স্যারোগেটেড মা-কে l তিনি কি সেই সন্তানকে পুরোপুরি ভুলে যেতে পারেন ? প্রতি মুহূর্তে যে সন্তান তাঁর দেহের মধ্যে বড়ো হয়েছে, তাঁর দেহরস শোষণ করেছে, তাঁকে কি করে ভুলে যাওয়া যায় ?  তার জন্য কি বুকটা টনটন করে ওঠে না ?  
হয়তো স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের জন্ম হয়েছে l হয়তো সিজার করতে হয়েছে l যদি সিজার হয়, তাহলে যে সন্তান কাছে থাকলো না, তার কারণে শরীরে সারাজীবন একটি ক্ষতস্থান বয়ে বেড়াতে হবে, এই বিষয়টিও মানবিক থেকে খুব বেদনার l


স্যারোগেটেড মাতৃত্ব বিষয়টি শেষ পর্যন্ত যেন এরকম - একজন কোনো কারণে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ছিলেন, তিনি সন্তান পেলেন l আর একজন সন্তান ধারণ করতে, জন্ম দিতে সক্ষম l সন্তান জন্মও দিলেন l কিন্তু তিনি সন্তান পেলেন না l এই পুরো প্রক্রিয়াতে চললো টাকার খেলা l টাকাই যেন শেষ পর্যন্ত জিতে গেলো l মাতৃত্ব বিক্রি হয়ে গেলো l অভাবের তাড়নায় শুধু কিছু অর্থের বিনিময়ে একজন নারী বুকে অনেক ব্যথা নিয়ে, মনে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে, অশ্রুসজল হয়ে পরের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন l বিষয়টি খুব সহজ নয় l সময়কালে সন্তান যখন হাতছাড়া হয় তখন মাতৃত্বের দংশন জ্বালা অনুভব করেন সেই পরিত্যক্তা মা l শরীরে, স্তনজোড়ায় টনটন ব্যথা অনুভব করেন l দু চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে l মা হয়েও তিনি মা নন - পরিস্থিতির এ কি নির্মম খেলা l তাঁর ভেতরের মা কেঁদে ওঠে l


অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যথাতুর মানবিক কবিতাদ্বয়ের জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা l