পৃথিবীতে কতো প্রানী । জীবন যাপনের তাগিদে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য, মনের লালসা পূরণের জন্য তাদের নানা সময়ে কতো ভেক ধারণ করতে হয় । যেমন বনের প্রানী, বর্নচোরা, কিংবা শ্বাপদ, সবুজ হলুদ ঘাসের আড়ালে থেকে আকস্মিক তার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । এই ভেক নিতে হয় কখনো আত্মরক্ষার জন্য, কখনো বা আক্রমনের জন্য । খাদ্য খাদকের সম্পর্কে এভাবেই প্রকৃতি টিকে আছে । সবাই সাধু হয়ে গেলে প্রকৃতি বাঁচে না ।


তবে প্রকৃতির মধ্যে ভেক ধরার বিষয়টি একটা মূল্যবোধের সুরে বাঁধা । আত্মরক্ষা ও নিতান্ত জীবনধারণের জন্য আক্রমণের মধ্যেই তা আবদ্ধ । অকারণে সেখানে সীমা লঙ্ঘনের বিষয়টি ঘটে না । প্রত্যেকে তার স্বাভাবিক আচরণবিধি মেনে চলে ।


কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই শৃঙ্খলার অভাব লক্ষ্য করা যায় । এই পৃথিবীতে যে মানবজাতির সৃষ্টি হয়েছে মহত্তম কাজ করার জন্য, স্রষ্টা ভগবানের বাণী ও আদর্শকে রূপদান করার জন্য, সেই মানবজাতি একটা মায়াবী চেহারার ভেক ধরে নানা ধরণের অন্যায়কার্য করে যাচ্ছেন । কবি সরকার পল্লব "অথচ তাদের সাধু সন্যাসী হবার কথা" রচনায় মানুষের এই ভন্ড রূপটি তুলে ধরেছেন ।


মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানা ভেক ধরে । কখনো সে প্রেমিকের বেশ ধরে, কখনো বা কবির । কিন্তু তার ভেতরে থাকে একটা লোভী, ইতর মন । নিজের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া যে আর কিছু বুঝে না ।


নানান দেবতার পূজার আড়ালে সে তার হীন উদ্দেশ্য পূরণ করে চলে । কখনো সে শুদ্ধতার কৈলাশে বসা মহাদেবের ভক্ত, কখনো বা সে কৃষ্ণের রূপ নেয়, কিন্তু তার হৃদয়ে সর্বদা অবস্থান করে দুর্যোধন । সব ক্ষেত্রেই সে জয়ী হতে চায় । নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়, মানবিকতার খেয়াল করে না । প্রেমের পরোয়া করে না । শুধু লোভের লেলিহান শিখা দ্বারা সে চালিত হয় । মানবহৃদয় যা হিমালয়সম উদারতার অধিকারী, সেখানে স্বার্থপরতা ও নীচতা বাসা বাঁধে ।


এই নীচতা মানুষকে মাতৃসমা নারীর সম্মান লুন্ঠন করতে প্রবৃত্ত করে । তারপরেই সে আবার শুদ্ধতার ভেক ধরে । পাপকাজ করার পর গঙ্গাজলে স্নান করে যেন পবিত্র হয়ে যায় সে । তারপর আবার তার পাপকাজ করার অধিকার জন্মে যায় । প্রকাশ্যে সৎ চরিত্রের মানুষের অভিনয় করে রাতের অন্ধকারে সে বারবনিতার কাছে যায় ।


মানুষের এই ভন্ডামি, এই দ্বিচারিতার কথা ভাবলে মনে ঘৃণা জন্মায়। কি বিপুল দক্ষতার সঙ্গে সে এই অভিনয় করে যায় ! যাঁর  সাধু-সন্যাসী হবার কথা, তাঁরাই সমাজের বুকে নানা ধরণের অনাচার করে চলেন ।


সর্বত্র হাটে-ঘাটে-মাঠে, শুদ্ধতার আড়ালে মানুষের ভেতরের নীচ প্রবৃত্তিগুলি জেগে ওঠে । অনাচারের  সুযোগ না পেলেই সে সাধু । সুযোগ পেলেই দুর্যোধন ।


গভীর বোধের রচনার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ! !