মানবমনের সংবেদনশীলতার এক বিশেষ স্তরে কবিতার জন্ম l যে জগৎ আমাদের সামনে দৃশ্যমান, যে ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায়, চৈতন্যের সংঘর্ষে
হঠাৎ একটি পংক্তি খেলে যায় আমাদের মনে l ধীরে ধীরে পংক্তির সংখ্যা বেড়ে কবিতার আকার নেয় l তা হয়ে ওঠে কোনো বোধ বা অভিজ্ঞানের ছন্দোবদ্ধ বা মুক্তছন্দ রূপ যা নির্দিষ্ট করে দেয় কীভাবে তা পঠিত বা আবৃত্ত হবে। আদিতে তো কবিতা ছিল শুধুই শ্রুতিশিল্প l কবিরা সুর করে অথবা কণ্ঠস্বরে তারতম্য এনে মানুষের সামনে পাঠ করতেন এবং সেটা স্মৃতিবাহী হয়ে ছড়িয়ে যেত যুগ থেকে যুগান্তরে। কবিগানের আসরে তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে কবিতা রচনা করে দর্শক শ্রোতাকে মাত করে দেয়ার ঐতিহ্য আছে l কবিতার মুদ্রিত রূপ মলাটবন্দী সাংকেতিক চিহ্ন মাত্র যা উদ্ধার হয় পাঠক এবং আবৃত্তিশিল্পীর অনুভবে, যথাযথ কণ্ঠশীলন এবং উচ্চারণে।

কবিতা মানুষের আদিতম প্রকাশ মাধ্যম l মানব অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত অনুভবের জগতকে কবিতা বহন করে l কবিতার ইতিহাস তাই মানব সভ্যতার ইতিহাসের সমান্তরাল। কবিতায় ব্যক্তি মানুষের প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বিষাদ, দ্রোহ-ক্ষোভের পাশাপাশি সমষ্টি মানবের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিদ্রোহ- সংগ্রাম এবং ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের আওয়াজ উঠে আসে। মিথুনাবদ্ধ ক্রৌঞ্চকে ব্যাধের শরে নিহত হতে দেখে রত্নাকর দস্যুর কণ্ঠে অকস্মাৎ উচ্চারিত শ্লোক জন্ম দেয় মহাকবি বাল্মীকি প্রতিভার l সত্তা ও সৃষ্টির আনন্দিত উৎসারণ ও তার মধ্যকার বাক্যালাপ রবীন্দ্রনাথের অনুভবে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে প্রকাশিত হয় l তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস যারা কেড়ে খায় তাদের সর্বনাশ লেখার জন্য বিদ্রোহী কবি নজরুল আবির্ভূত হন। কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়ভেদে কবিতার ভাষা, বিষয় ও প্রকরণ পরিবর্তিত হয় l কবিতার বিশেষ বিশেষ ধারার উদ্ভব ঘটে, জনপ্রিয় হয় অথবা কালের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।


কবিতার সাথে আবৃত্তির সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনই কবিদের সাথে আবৃত্তিকারদের সংযোগ তাৎপর্যবাহী যা কবিতাকে পাঠক শ্রোতাদের কাছে তার যথাযথ গুরুত্ব এবং ওজস্বিতায় উপস্থাপন করতে পারে। দেখা যায় আবৃত্তিকারেরা সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট কবিতা ঘুরে ফিরে আবৃত্তি করেন এবং কবিতার নির্বাচনে প্রধানত শ্লোগানধর্মী কবিতা তাদের পছন্দ যা তারা প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চকণ্ঠে পড়ে থাকেন যার লক্ষ্য মঞ্চ মাত করা এবং সস্তা হাততালি। অন্য ধরণের কবিতার আস্বাদ গ্রহনে তাঁরা পরাঙ্মুখ অথবা অনিচ্ছুক যা সামগ্রিকভাবে কবিতার জন্য ক্ষতিকর। অধিকাংশ কবি এবং আবৃত্তিকার উভয়ই এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসান।
কবিতাকে তার স্বভাবধর্মে ফেরাবার জন্য পরবর্তী কালের কবিরা মঞ্চকে বর্জন করেন এবং কাব্যভাষায় এমন এক অন্তর্লীনতার সন্ধান করতে থাকেন যা সংক্ষুব্ধ স্বদেশের স্বাভাবিক উত্তাপ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং কবিতার জনসম্পৃক্তি দ্রুত হারে হ্রাস পায়। এর ভেতরে একটা মধ্যস্থতা জরুরী বলে মনে হয় যাতে করে  কাব্যসৃষ্টি ও তার পাঠের মধ্যে একটা সেতু গড়া যায়।


অনেক কবিই কবিতাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আবৃত্তির ভূমিকাকে কমবেশি স্বীকার করেছেন । বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ *পবিত্র সরকার তো আবৃত্তিকে শিল্পই বলেছেন যেমন কবি *মৃদুল দাসগুপ্ত আবৃত্তিকে শিল্প বলে মানেন নি ।


কবিতা নিবিড় পাঠের বিষয় । নিভৃতে পাঠের বিষয় । তার বেঁচে থাকার জন্য আবৃত্তির আশ্রয় জরুরী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় । কবিতাকে বেঁচে থাকতে হবে তার নিজের শক্তিতে । তার গ্রাফিক উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে । আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আবৃত্তিকারেরা কেবল মুষ্টিমেয় কিছু কবির জনপ্রিয় কবিতাই আবৃত্তি করেন । বহু বহু কবি, বলা যেতে পারে অধিকাংশ কবি, বিশেষ করে নতুন যাঁরা লিখছেন তাঁরা আবৃত্তিকারদের কন্ঠ পান না । ফলে কবিতাকে জনপ্রিয় হতে হলে কবির নিজের উদ্যোগে তা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।


আবার এমন মতও আসে যে একমাত্র কবিই তাঁর কবিতা পাঠ করে তার মর্মগ্রহনে অন্যকে সহযোগিতা করতে পারেন । একজন আবৃত্তিকার হয়তো ততটা পারেন না । কবি তাঁর নিজের  কবিতার ভাবগ্রহণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তি এ পর্যন্ত ঠিক আছে । কিন্তু সেই ভাব শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপনের প্রশ্নে সকল কবি কন্ঠের দিক থেকে, উচ্চারনের দিক থেকে, ভাবের যে বৈচিত্র্য তার প্রকাশে গলার যে কাজ তার দিক থেকে সমান দক্ষ এটা বোধ হয় জোর দিয়ে বলা যায় না । একজন প্রকৃত আবৃত্তিকার এক্ষেত্রে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন । বলার কথা হলো কবিতার সঙ্গে আবৃত্তির কোনো বিরোধ নেই । কবি লেখেন । আবৃত্তিকার সেটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন । কবিতা ছাড়া আবৃত্তির কোনো অস্তিত্ব নেই । আবার আবৃত্তি ছাড়া কবিতা একটু হলেও দুর্বল ।
প্রশ্ন হলো আবৃত্তি শিল্প কি না ! বিষয়টি বিতর্কিত । এ বিষয়ে মত দেবার আগে নিজের অভিজ্ঞতার আশ্রয় নিবো ।
একটা কবিতা পড়লাম । নিজের মতো করে । নিবিড়ভাবে এবং নিভৃতে । ভালো লাগলো কবিতাটি । একটা স্তর পর্যন্ত সেই ভালো লাগাটা মনের মধ্যে অনুভব করলাম । তারপর একদিন হঠাৎ কোনো অনুষ্ঠানে দেখি এক ভালো আবৃত্তিকার সেই কবিতাটি আবৃত্তি করছেন । তার কন্ঠে সেই কবিতাটির আবৃত্তি শুনে আমার যেন মনে হলো কবিতাটিকে নতুন করে পেলাম । যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা । নিজে মনে মনে যে কবিতাটি পড়েছিলাম তার শব্দবিন্যাসের মধ্যে যে এতো অসীম ভাব ও বোধের সম্ভাবনা রয়ে গেছিল তার উপলব্ধি কবিতাটিকে আমার কাছে নতুন করে উপস্থাপিত করলো । যন্ত্রণাক্লিষ্ট, আবেগতাড়িত যে অনুভব ফুটে উঠলো কবিতাটিকে ঘিরে তা আমার কাছে নতুন পাওয়া । এটা সম্ভব হলো ঐ আবৃত্তিকারের চমৎকার কন্ঠ, নিবিষ্ট উচ্চারণ এবং কবিতাটির সঙ্গে যথোপযুক্ত একাত্মতার কারণে । একটি কবিতার যে বহুবিন্যস্ত স্তর, একজন ভালো আবৃত্তিকার প্রথমে তা নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেন । তারপর সেই অনুভব তিনি সঞ্চারিত করেন শ্রোতার মধ্যে । ফলে তিনি একজন শিল্পীর কাজই করেন । শিল্পীর কাজই হলো সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করে তা অপরের মধ্যে সঞ্চারিত করা । এই অর্থে আবৃত্তিকার একজন শিল্পী এবং আবৃত্তি শিল্প ।


গীতিকার গান লিখলেন । সুরকার সুর আরোপ করলেন । একজন গায়ক সুর তাল সহযোগে তা গেয়ে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করে সেই গানকে জনপ্রিয় করে তুলছেন । সেই গায়ককে যদি শিল্পী বলে আমরা মেনে নেই, তাহলে আবৃত্তিকারকে কেন নয় ? কবিতার ক্ষেত্রে তিনি সেই কাজটিই করেন ।


কবি একটি কবিতা যখন লেখেন এক জন্মযযন্ত্রণা অনুভব করেন তিনি । একজন আবৃত্তিকার বারবার আবৃত্তির মাধ্যমে কবির সেই কবিতার জন্মকালীন অনুভবের মুহূর্তে পৌঁছে যান, যেন একই প্রসূতিবেদনায় ক্লিষ্ট ও হৃষ্ট । কবি নিজে কিন্তু তখন অন্য কবিতা নিয়ে ব্যস্ত । অন্য কবিতা জন্ম দেবার অনুভবে ভাবিত । কিন্তু আবৃত্তিকারই কবিতাকে বারবার আবিষ্কার করেন তার পুনরুদ্ধারের মধ্যে দিয়ে । এই অর্থে তিনিও একজন স্রষ্টা । সুতরাং শিল্পী ।
মুখে মুখে কবিতা বলার এই যে ধারা এটা নতুন নয় । যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে । সেই বেদের কাল থেকে । যুগান্তরের এই যে সাধনা, তার পরম্পরা, তাকে শিল্প বলে মেনে নিতে সঙ্কোচ হবার কথা নয় ।


তবে আবৃত্তিকারমাত্রই শিল্পী নয় । তার জন্য চাই কন্ঠ । চাই সাধনা । কবিতা নির্বাচন, সেই কবিতা বুঝে নেবার ক্ষমতা, তাকে পুনর্গঠন করার যোগ্যতা চাই । চাই গলার কারুকার্য, শব্দের নিজস্ব বহুবিধ স্তরবিন্যাসকে অনুসরন করার যোগ্যতা ।
এমন অনেক তথাকথিত আবৃত্তিকার আছেন যাঁদের আবৃত্তি শুনে স্বয়ং কবি রুষ্ট হন । এঁদের অনেকে আবৃত্তি করেন ঝাঁপিয়ে, লাফিয়ে, কেউ বা মঞ্চ কাঁপিয়ে । তাঁরা ভুলে যান কবিতা আবৃত্তির তাগিদ আসে প্রাণের ভিতর থেকে, কবিতাকে বারবার নিজেকেই শোনানোর আগ্রহে । তাঁরা কবিতার পবিত্র শরীরকে বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে ছুঁতে পারেন না বলে অভিযোগের আঙুল ওঠে ।  


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন তাঁর গান সকলের কন্ঠে ছড়িয়ে পড়ুক । সারা জগত জুড়ে । তাঁর এই ইচ্ছা অনেকাংশে পূরনও হয়েছে । কিন্তু সেই তিনিই কয়েকজন গায়ক গায়িকার কন্ঠে তাঁর গান শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন । যেমনটা ক্ষুব্ধ হন একজন দায়িত্বসচেতন বিদগ্ধ কবি তাঁর কবিতার অপটু আবৃত্তি শুনে ।
আবৃত্তি একটি কবিতার পুনর্জন্ম । যাঁরা এটা সঠিকভাবে করে উঠতে পারেন তাঁরাই শিল্পী এবং তাঁদের হাতেই আবৃত্তি শিল্প হয়ে ওঠে ।


** সাঁকো পঞ্চম বর্ষ দশম সংখ্যা ২০১৯ এ প্রকাশিত