বাংলা কবিতা আসরে ১৪ জন এপার এবং ওপার বাংলার বিশিষ্ট কবির প্রায় দেড় হাজার কবিতা উপলব্ধ l আছেন আট হাজারের অধিক নথিবদ্ধ কবি, যদিও তাঁদের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার কবি আসরে কবিতা যোগ করেছেন l আজকের তারিখে এই কবিতার সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজারের মতো  l প্রতিদিন গড়ে ১৪০ টির মতো নতুন কবিতা আসরে যোগ হয়ে এই সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে l কিন্তু তার বাইরেও কবিতার এক বিশাল ভাণ্ডার পড়ে আছে l আমাদের পূর্ব কবিরা ঐতিহ্যময় কাব্যের যে ভাণ্ডার রেখে গেছেন তার স্বাদ চিরন্তন । তবুও তার বাইরে দুই বাংলার এই প্রজন্মের কবিরা আছেন, যাঁরা খুব ভালো লিখছেন l তাঁদের মধ্যে এই বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ) কবিদের লেখাতে কি আছে, লেখাতে তাঁরা কি ভাবছেন, তাঁদের পরিচয়, তাদের লেখায় ধরন কি রকম তার চর্চার জন্য আসরে এক সুন্দর প্রয়াস শুরু করেছেন কবি দীপঙ্কর 'পাঠকনামা' সিরিজের মাধ্যমে l
ইতিমধ্যেই পাঠকনামা সিরিজে ১৬ জন কবির প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে l তাঁরা হলেন :
১) শ্রীজাত, ২) পিনাকী ঠাকুর,৩) মন্দাক্রান্তা সেন, ৪) রণজিৎ দাশ, ৫) যশোধরা রায়চৌধুরী, ৬) শ্যামলকান্তি দাশ, ৭) বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ৮) অমিতাভ দাশগুপ্ত, ৯) উৎপল কুমার বসু, ১০) কবিতা সিংহ, ১১) বিভাস রায় চৌধুরী, ১২) অনিতা অগ্নিহোত্রী, ১৩) সমর সেন, ১৪) সমীর রায়  চৌধুরী, ১৫) ভাস্কর চক্রবর্তী, ১৬) বিনয় মজুমদার (বিনয়যাপন - এক, দুই) l
কবি দীপঙ্কর- এর কলমে সম্প্রতি পড়লাম কবি বিনয় মজুমদার সম্পর্কিত প্রাথমিক আলোচনা এবং কবির কিছু কবিতা l কবিতাগুলি অসাধারণ নিঃসন্দেহে l তার মধ্যে একটি কবিতা - "কবিতা বুঝিনি আমি" - খুব ভালো লেগেছে l কবিতাটির বিষয় হলো কবিতার দুর্বোধ্যতা l বিশেষ করে আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি করে বলা হয় l  
যেহেতু এই বিষয়ে আসরে বিভিন্ন সময়ে নানা আলোচনা হয়েছে, তাই আজ প্রখ্যাত কবি বিনয় মজুমদারের চোখে তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে বিষয়টিকে বুঝে নিতে চেষ্টা করবো l কবিতায় দুর্বোধ্যতা থাকে, কবি এটা মেনে নিয়েছেন l এই দুর্বোধ্যতা পাঠক কি করে কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং কবিতার দুর্বোধ্যতার বাধাকে জয় করে কিভাবে পাঠক কবিতায় অন্তর্নিহিত অর্থ ও ভাবের রসাস্বাদন করতে পারেন তার দিকনির্দেশ আছে কবিতাটিতে l


মূল কবিতা :
কবিতা বুঝিনি আমি / বিনয় মজুমদার


কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে –
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি- সব;
লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি ।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।


আলোচনা :


পাঠক যখন প্রথমবার একটি কবিতা পাঠ করেন, তিনি কিছুই বুঝতে পারেন না l পারলেও খুব সামান্য l বিষয়টিকে কবি তুলনা করেছেন গভীর অন্ধকারে একটি জোনাকির আলোর সঙ্গে l জোনাকির সেই কোমল আলো নিরুত্তাপ l সেই ক্ষীণ আলোতে অন্ধকারে ঘেরা চারপাশটা ভালো করে দেখা যায় না l যেমনটা প্রথম পাঠে কবিতার বিষয় বোধগম্য হয় না l জোনাকির আলোতে যেটুকু দেখা যায়, তার বাইরে যেমন বিশাল জগত না দেখা থাকে, তেমনই প্রথম পাঠে কবিতার যতটুকু বোঝা যায়, তার বাইরে না বোঝা বিশাল অংশ থাকে l যেন দৃষ্টির বাইরে থেকে যায় নীলাভ প্রকৃত আকাশ, তার তারামন্ডল l
কিন্তু কবিতাটির একাধিক পাঠে, বারংবার পাঠে, নিরলস প্রচেষ্টায় পাঠক কবিতার অন্তর্নিহিত বোধ উপলব্ধি করেন l এই বোধ তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে l তাঁকে ভবিষ্যতের দিকে যুগ যুগ এগিয়ে নিয়ে যায় l জোনাকির আলো ছাড়িয়ে সব তারকার আলোতে না দেখা গহ্বর অন্ধকার তাঁর দৃষ্টিগোচর হয় l দুর্বোধ্যতা ভেদ করে কবিতার গভীর বোধ তাঁর বোধের অস্পষ্টতা পার করে হৃদয়ের গভীর অবধি পৌঁছয় l অনুভবের গভীরে l এটা সম্ভব হয় বারংবার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে l তখন কবিতার বোধ এত আয়ত্তাধীন হয় যেন, যে জ্যোৎস্না অধরা ছিল, তা হাতের মুঠোয় ধরা দেয় l তখন মনের আনন্দে বিশ্রামরত অবস্থাতেও সেই বোধের সঞ্চার আমাদের সক্ষম করে বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির সরাৎসার পেতে l দুর্বোধ্যতা যেমন কবিতার শব্দে, বাক্যে, অজ্ঞানতা তেমন  পাঠকের রক্তে l শান্ত আহ্বান থাকে উভয়ের, উভয়ের প্রতি l নিরন্তর পরিচয়ে, অনর্গল প্রচেষ্টায় কবিতার দুর্বোধ্যতা এবং পাঠকের অজ্ঞানতা পথ ছেড়ে দেয় কবিতার প্রকৃত বোধকে l লবণ স্বাদের প্রতীক l সেই স্বাদের অনুভবে পাঠক কবিতার রসাস্বাদন করেন l


এই কবিতার বক্তব্যের সঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতার মিল দেখি l বিগত ছয় মাস ধরে এই আসরে দুই বাংলার বিভিন্ন কবির দেড় শত কবিতা আলোচনা করলাম l অনেক কবিতার ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে যে কবিতাটির প্রথম পাঠে কিছুই বুঝি নি l যদি কবিতাটি পড়তে ভালো লেগেছে, তাহলে পুনরায় পড়েছি l বারবার পড়েছি l তবে গিয়ে কবিতার ভাব কিছুটা বোধগম্য হয়েছে l তাও সব কবিতার ক্ষেত্রে নয় l অনেক ভালো লাগা কবিতা বারংবার পড়েও যখন পাঠোদ্ধার করতে পারি নি, সেটা আলোচনা করা যায় নি l আর যে কবিতাগুলি কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয়েছে, সেগুলি আলোচনা করেছি l যে কবিতাগুলি আলোচনা করেছি, কবিতার বোধের সঙ্গে কল্পনাকেও ব্যবহার করেছি কবিতাটির পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে l


কবি বিনয় মজুমদার বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছেন l  রবীন্দ্রনাথ- নজরুল - জীবনানন্দ পরবর্তী উজ্জ্বল কবি হিসেবে বিনয় মজুমদারকে গণ্য করা হয় মূলত কবিতায় গণিত ও বিজ্ঞানের যুক্তি উপস্থাপন এবং স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের কারণে।
জীবনানন্দ দাশের "হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা" বক্তব্যটি কবি বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে খেটে যায়। অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে কবিতায় তিনি তুলে ধরেন তাঁর নানা অভিজ্ঞতা, আশা-ব্যর্থতা, অনুরাগ, অপ্রাপ্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ l তাঁর কবিতাগুলো যেন আত্মকথন, শান্তরস সিক্ত, তীব্র ব্যঞ্জনাধর্মী ও গভীর অর্থবোধক।
তাঁর কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কবিতার মর্মার্থ কবিতাটি একবার পাঠ করে পাওয়া যায় না l তাঁর কবিতায় কবিতার বোধ আপাতসরল নয়। কবিতা পাঠে নতুন চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে l ফলে তাঁর কবিতার পাঠ গভীর অভিনিবেশ দাবি করে। ঠিক এই বিষয়টিই ফুটে উঠেছে "কবিতা বুঝিনি আমি" কবিতাটিতে l
কবিতা হলো একজন কবির জীবনের অভিজ্ঞতার সারাৎসার l কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় বোধ। কবিতা কোনো তুচ্ছ অলঙ্করণ নয়, এটা উৎকর্ষতার ভেতরে গভীরভাবে প্রবেশ করার মতো একটি বিষয়, যা আমরা অতিক্রম করি, অস্থির আবেগ থেকে ধ্যানের প্রশান্তির দিকে। অস্থির আবেগ কবিতার উত্স, ধ্যানের প্রশান্তি কবিতা সৃষ্টির শর্ত l