*****************
কতইবা আমার বয়স তখন।
এই আট কি দশ মাস হবে।
পৃথিবীতে নতুন মেহমান,
মা এর কোলে প্রথম সন্তান।
মা আমার রূপসি না হলেও সুন্দরী ছিলেন বেশ।
বয়স কতই বা হবে তার,
ধর, বিশ কি বাইশ।
বাবা আমার তাগড়া জোয়ান;
আর্মিতে সৈনিক।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলাবদ্ধ
বীর সৈনিক, খুব সাহসি,
দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ।
শেষবার যখন বাবা
বাড়ি এলেন ছুটিতে
তখন ছিল উত্তাল মার্চের অগ্নিঝরা দিন।
বঙ্গবন্ধু ডাকে বাবা দিলেন সাড়া ,
দেশের জন্য লড়তে হবে।
রক্ত নাকি আরো দিতে হবে।
তবেই দেশ হবে শত্রু মু্ক্ত
আর হবে নাকি স্বাধীন।
বাবা আমার সদ্য জোয়ান,
রক্তে তার ডেকেছিল বান স্বাধীনতার নেশায় বাবা
অস্ত্র তুলে নিলেন হাতে।
মা কে ডেকে বলেন বাবা,
দেশ আমায় ডাক দিয়েছে আনতে স্বাধীনতা।
ছুটি আমার শেষ।
খোকা আমার দেখে রেখো
আর তুমিও থেকো বেশ।
অবাক চোখে মা ভাবেন,
স্বাধীনতা! সেটা আবার কী তা!
এমনিই তো বেশ আছি,
তুমি আছো, আমি আছি,
আর আছে আমাদের খোকা।
সুখে আছি আমরা সবাই
কি করবো আমি স্বাধীনতায়?
মিষ্টি হেসে বাবা তখন
মাকে ডেকে বলেন,
স্বাধীনতা সোনার হরিণ,
আনবো দেখো আমি একদিন।
তোমার জন্য আর আমার সোনা মানিকটার জন্য।
মা আর আমার কপালে এঁকে দিয়ে ছোট্ট মিষ্টি চুম্বন রেখা
বাবা আমার চলে গেলেন
আনতে স্বাধীনতা।
মাস দুই পরে কতক জোয়ান
খাকী পোশাক পরে
ঘুমন্ত আমায় মা'র কোল থেকে
ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
নিয়ে গেলো ধরে আমার মাকে
অমানবিক আর পৈশাচিকতায়
আমার মায়ের সোনার অঙ্গ
হল ক্ষত বিক্ষত।
মা আমার পাগল প্রায়
থাকেন উদাস চেয়ে
সেই পথেতে যে পথ দিয়ে
বাবা আমার স্বাধীনতা নামের
সোনার হরিণ আনতে গেছেন ধরে।
কয়েক দিন পর মায়ের কাছে
লোক মারফত চুপিসারে এলো,
বাবার লেখা একটা খোলা চিঠি।
"আর কটা দিন সবুর কর।
লক্ষ্মী বৌ,
আনছি তোমার সোনার হরিণ।
সোনার হরিণ ধরতে মোরা জাল পেতেছি, তীর ছুঁড়েছি।
লক্ষ্মী ছাড়া পড়বে ধরা।
আর ভেবো না।"
বাবার চিঠি পড়ে মা বুক ভাসালেন কেঁদে।
সেই যে গেলেন বাবা আমার
আর না এলেন ফিরে।
নয়টি মাসের যুদ্ধ শেষে
সবাই এলেন বিজয়ী বেশে।
মা তখনো ছিলেন অপেক্ষায়।
বাবা ও তার সোনার হরিণের প্রতিক্ষায়....
একে একে সবাই এলো,
যোদ্ধা ছিল যত,
ছেচল্লিশ বছর কেটে গেল
আমার বাবা এলো নাতো,
শেষে মায়ের প্রাণখানি একদিন নিয়ে গেলেন প্রভু।
আজও আমি বাবার মত
খুঁজে ফিরি স্বাধীনতার
সোনার হরিণটাকে।
বলতে পারো সেটা এখন
কোন গগনে থাকে?
বাবা পায়নি, মা পায়নি
আমিও দেখিনি কভু।
স্বাধীনতার সোনার হরিণ
সে তো শুধু মুখে মুখে
আর গল্প কবিতার পংঙ্কতিতে
শোভা বাড়ায়, ছন্দ মিলায়।
--------+++++---------
জোহরা খাতুন
৮.১২.১৭