চল্লিশ পেরোনো নারী, জীবনের বয়ঃসন্ধিকালে  
চুপচাপ; যেন তা দেয়া ওমের মুরগীর মতো
ঝিম ধরে ভাবে, পৃথিবীর যাপিত জীবন নিয়ে।
অদ্ভুত বয়স তাঁর! এখন সে, না ছুঁড়ি, না বুড়ি।
কখনো কখনো তাঁর মনের গহীনে খেলে যায়
কিশোরীর উচ্ছ্বলতা, বাঁধভাঙ্গা হাসি, বাতুলতা।
হাস্যকর ভেবে ক্লান্তিকরভাবে অবদমনের
প্রচেষ্টা চালায় নিজে, নিরিবিলি, অদ্ভুত রকমে।
ঘর-সংসার, অফিস, সাজসজ্জা, কিংবা রান্নাবান্না,
স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা লালন-পালন ইত্যাদির শেষে,
বাস্তবের পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়-আসয় নিয়ে;
আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়। মনে হয়- কেউ নেই,
কিছু নেই, অনন্ত শূন্যতা একাকার হয়ে আসে।
না-পাওয়ার বেদনার ট্র্যাজিক নাটকে, এ জীবন
শুধুই সুখের অভিনয় করে বেলা কেটে যায়।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে, সেই নস্টালজিক শৈশব,
তারুণ্যের চঞ্চলতা, যৌবনের অমিয় দিবস;
বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্প, বৃষ্টি-বিলাস কতো কী!
এখন, সমস্ত দিন কাটে হাজার কাজের ভীড়ে।
সব কাজ সেরে, যখন একাকী রাতের বেলায়
আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়; তখন নিজেকে খুব
অসুন্দর মনে হয়। ছিপছিপে উজ্জ্বল শরীরে,
মুখে বলিরেখা, চুলে পাক, চোখের কার্ণিশে কালি;
চিরুনীর সাথে উঠে আসা মুঠো মুঠো মরাচুল,
গায়ে জমে উঠা অনাকর্ষণীয় দলা দলা মেদ;
বুকে-পেটে আঁকিবুকি, বিশ্রী দাগ, খসখসে ত্বক;
বিষন্নতা ঘিরে ধরে দেহে, মনে, চিন্তা ও চেতনে;
ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ভবিষ্যৎ আর বর্তমান।
দুর্নিবার জীবনের অর্ধেকটা পার হয়ে যায়,
অথচ, কাঙ্ক্ষিত প্রেম পেলো না সে; মিটলো না সাধ।
কতো কথা জমা হলো মানবীর মনের গহীনে;
কেউ নিরিবিলি পাশে বসে থেকে শুনতে এলো না,
অথবা শোনাতে চাইলো না প্রেমের গোপন কথা।
কারোর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে মন চায়;
অথচ, কেউই তার ইচ্ছাকে সম্মান জানালো না।
অতৃপ্তির বেদনারা ঘিরে ধরে দেহ-ভাবনাকে,
কুড়েকুড়ে খায় মধ্যবয়সী নারীর কষ্টকথা।
তখনি, বিগত হয়ে যাওয়া, বাবা-মা'র স্মৃতিগুলো
খুব করে মনে পড়ে। সকলের অগোচরে কাঁদে।
এ মানুষজীবনের অধিকারবোধ ছেড়েছুঁড়ে,
সন্তানকে আঁকড়ে ধরে মমতায়, বুকের গহীনে;
তখন অন্যরকমভাবে সে বাঁচার চেষ্টা করে।
সংসার দাসত্ব থেকে মুক্তি চায়, চায় স্বাধীনতা;
কিন্তু পেরে উঠে না কখনো; সংস্কারের যাঁতাকলে
পিষ্ঠ হতে থাকে অহরহ; কাঁদে গোপনে গোপনে
শত অভিমান, ভয়, বেদনাকে বুকে নিয়ে। কাঁদে
আর বেঁচে রয় সন্তানের মুখপানে চেয়ে থেকে।
তাঁর কান্না এতো গভীর যে, কেউ শুনতে পায় না,
কান্নার রহস্য কেউ কখনোই জানতে চায় না;
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে; কিন্তু, সে পারে না।
নিজের ভেতরে নিজে প্রতিদিন মরে আর বাঁচে।
মধ্যবয়সী মেয়ের উজ্জ্বল মনটা ধীরে ধীরে
নীল হতে থাকে; একসময় নিকষ কালো রঙে
একাকার হয়ে মিশে যায় অন্ধকারের গহীনে।
তার নিঃশব্দের কান্না বয়ে যায় ফল্গুধারা হয়ে,
দুঃখ ভারাক্রান্ত সুরে; দূর অনন্তের অন্তরীক্ষে।


০২/০৪/২০২২
মিরপুর, ঢাকা।
৫৬