কবি চিত্ত রঞ্জন সরকার (জাগ্রত বিবেক)-এর লেখা "মতবাদী ধর্মে বিশ্বাস" কবিতাটি ধর্ম, বিশ্বাস এবং মানবসৃষ্ট মতবাদের একটি গভীর দার্শনিক আলোচনা। কবি এখানে প্রকৃতিকে ধর্মের উৎস হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং মানবসৃষ্ট মতবাদের সীমাবদ্ধতা ও কুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

কবিতাটি মূলত দুটি প্রধান ধারণার মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি করে: প্রকৃতির ধর্ম বনাম মানব-সৃষ্ট মতবাদী ধর্ম। প্রথমেই কবি বলেছেন, "প্রকৃতি শেখায় নিত্যকর্ম / প্রকৃতি শেখায় ধর্ম; আমরা বুঝেও বুঝিনা তা / কর্মের ওই মর্ম।" এখানে কবি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মাবলী এবং তার থেকে উদ্ভূত নৈতিকতা বা ধর্মকে বোঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃতির সকল কর্মকাণ্ড একটি নির্দিষ্ট নিয়মে চলে, যা থেকে মানবজাতি তাদের কর্তব্য এবং সঠিক জীবনযাপনের শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু আমরা সেই সহজ সত্যকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ।

এরপরই কবি মানবসৃষ্ট মতবাদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন: "মানব সৃষ্ট মতবাদকেই / ধর্ম বলে মানি; প্রকৃতির ওই ধর্মাচরণ / বিশ্বাসে টানাটানি।" এই পংক্তিগুলোতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ নিজেদের তৈরি করা বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদকে প্রকৃত ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছে, যখন কিনা প্রকৃতির শিক্ষাকে তারা উপেক্ষা করছে। প্রকৃতির সহজ, সার্বজনীন ধর্মকে গ্রহণ করতে তাদের মনে এক ধরনের সংশয় কাজ করে।

"চোখ থেকেও অন্ধ আমরা / অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী; তার পরিনাম বিভেদ শুধুই / নির্বোধের মতো হাসি।" এই লাইনগুলোতে কবি আমাদের অজ্ঞানতা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতি তীক্ষ্ণ কটাক্ষ করেছেন। আমরা চোখ থাকতেও যেন দেখতে পাই না, বিচার-বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও অন্ধভাবে বিশ্বাস করে চলি। এর ফলস্বরূপ সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং এই বিভেদ দেখেও আমরা নির্বোধের মতো হাসতে থাকি, যা আমাদের আত্মঘাতী মনোভাবের পরিচায়ক।

কবি আরও বলেছেন, "সত্যকে ফেলে মিথ্যাকে ধরে / সবাই সুখী হতে চাই; তাই জিজ্ঞাসিলে ওই নিজেকে / সত্যিই উত্তর কি পাই?" এখানে কবি মানুষের একটি মৌলিক প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মানুষ মিথ্যা এবং ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে সুখ খুঁজতে চায়, কিন্তু যখন তারা নিজেদের গভীরভাবে প্রশ্ন করে, তখন কি তারা সত্যিকারের কোনো উত্তর পায়? এই প্রশ্নটি আসলে আত্ম-উপলব্ধি এবং সত্যের অনুসন্ধানের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

শেষের পংক্তিগুলোতে কবি এই ভুল পথের ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরেছেন: "মিথ্যার পিছে ঘুরে ঘুরে / সৃষ্টি হোল অসত্যের জঙ্গল; মনুষ্যত্বের সব গুণ ছেড়ে / তৈরি পাশবিক পরিমণ্ডল।" মিথ্যা এবং ভ্রান্ত ধারণার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যেন এক অসত্যের জঙ্গলে প্রবেশ করেছি। এর ফলে মানুষ তাদের মানবিক গুণাবলী হারিয়ে পাশবিক ও হিংস্র হয়ে উঠেছে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হলো "হিংসা বিদ্বেষ তার পরিণাম / চলে আগুন নিয়ে খেলা; এমনি করেই এই জীবনের / হয়তো কেটে যাবে বেলা।" কবি এখানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই পথ চলতে থাকলে আমাদের জীবন কেবল হিংসা-বিদ্বেষ আর সংঘাতের আগুনে পুড়েই শেষ হয়ে যাবে।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, কবি চিত্ত রঞ্জন সরকার কর্তৃক রচিত "মতবাদী ধর্মে বিশ্বাস" কবিতাটি আধুনিক সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস এবং এর ফলে সৃষ্ট বিভেদ ও সহিংসতার এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছে। কবি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে প্রকৃত ধর্ম প্রকৃতির মধ্যে নিহিত, যা মানবতাকে এক করে এবং শান্তির পথ দেখায়, কিন্তু মানবসৃষ্ট মতবাদগুলো প্রায়শই বিভেদ ও ধ্বংসের কারণ হয়। এটি একটি চিন্তা উদ্রেককারী কবিতা যা আমাদের নিজেদের বিশ্বাস এবং তার পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে উৎসাহিত করে। কবি কি অশেষ ধন্যবাদ বাস্তবতার নিরিখে ধর্ম এবং ধর্মাচারণ নিয়ে একটি সুন্দর কবিতা আমাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য।