কবি জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল-এর ছন্দময় কবিতা "ফেবুর ব্যবসা" কবিতাটি বর্তমান সমাজের একটি গভীর সংকটের চিত্র তুলে ধরেছে। কবিতাটিতে কবি আধুনিক প্রযুক্তির, বিশেষ করে ফেসবুকের (ফেবু) অপব্যবহার এবং এর ফলে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও নির্ভীকভাবে তুলে ধরেছেন।

কবিতাটি শুরু হয় নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে নারী জননী, কন্যা, ভগ্নী। কিন্তু এরপরই কবি দেখান, কীভাবে এই নারীর শরীরকেই "অগ্নিগিরির অগ্নি"র মতো উপস্থাপন করা হচ্ছে ফেসবুকে। "ফেবুর বুকে আছড়ে পড়ে তাদের দেহের ভাঁজ" - এই লাইনগুলো বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নগ্নতা ও অশ্লীলতার ব্যাপক প্রসারকে ইঙ্গিত করে।

কবি লক্ষ্য করেছেন যে, এই ধরনের বিষয়বস্তু সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। কেউ "ছিঃ" বলে ঘৃণা জানাচ্ছে, কেউ "আহ্" বলে বিস্ময় প্রকাশ করছে, আবার কারো কাছে তা ভালো লাগছে। এই ভিন্ন প্রতিক্রিয়াগুলি সমাজের মধ্যে নৈতিকতার মানদণ্ডের ভিন্নতা এবং এক ধরণের বিভাজন তুলে ধরে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই অশ্লীলতার কারণে তরুণ প্রজন্ম বিপথে যাচ্ছে। "নেশার গাঙে ডুবছে তরুণ মেধাবীদের আলো" - এই পঙক্তিটি বোঝায় যে, তরুণরা পড়ালেখা বা সৃজনশীল কাজে মনোযোগ না দিয়ে, ইন্টারনেটের এই অন্ধকার জগতে আসক্ত হচ্ছে; যা তাদের মেধা ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করছে।

কবিতায় শুধু নগ্ন ছবি বা ভিডিওর কথা বলা হয়নি, বরং "অশ্লীল লেখায় মন কেড়ে নেয় অরির" উল্লেখ করে এর মানসিক প্রভাবের উপরও জোর দেওয়া হয়েছে। এই আসক্তি তরুণদের মনকে এমনভাবে গ্রাস করছে যে তারা অন্য কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছে না।

বিভিন্ন বয়সের মানুষের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কবি সমাজের সামগ্রিক হতাশা তুলে ধরেছেন। এহেন নগ্নতা ও অশ্লীলতার বিষয়ে মগ্ন থাকে তরুণ-তরুনী, যুবক-যুবতী। প্রৌঢ়রা হচ্ছেন বিচলিত ও উদ্বিগ্ন। আর বৃদ্ধগণ "গেল গেল" বলে অসহায়ভাবে পরিস্থিতি দেখছেন, কিন্তু এর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। কবি প্রশ্ন রেখেছেন, যারা এই "নগ্ন ব্যবসায়" মগ্ন, তারা কি সমাজের এই অবক্ষয়ে সাড়া দিচ্ছে? এর মাধ্যমে তিনি তাদের দায়িত্বহীনতা ও নির্লিপ্ততাকে কটাক্ষ করেছেন।

শেষের পঙক্তিগুলোতে কবি এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি তুলে ধরেছেন। "প্রজন্ম আজ পড়ালেখার গণ্ডি করে পার, ফেবুর রঙিন রসের খোঁজে ব্যস্ত গুঁজে ঘাড়" - এই লাইনটি শিক্ষাজীবন শেষ করেও বাস্তব জীবনে ব্যর্থতা এবং প্রযুক্তির এই অসুস্থ বিনোদনে আসক্তির চিত্র তুলে ধরে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হলো সমাজ ও সংসারের ধ্বংস এবং স্বপ্নের বিনাশ। "নগ্ন ব্যবসার অগ্নিঝড়ে ডুবছে বিশ্বটাই" - এই পঙক্তিটি দিয়ে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট সমাজের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা আধুনিক বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।

কবি জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল এই কবিতার মাধ্যমে সমাজের একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি প্রযুক্তির (বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) অপব্যবহারের কারণে সৃষ্ট নৈতিক অবক্ষয়, তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতা এবং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ভাঙন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই কবিতাটি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন হওয়ার এবং এর প্রতিকারে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।

'ফেবুর ব্যবসা' কবিতাটি যেমন বাস্তবতার নির্মম চিত্র তুলে ধরে, তেমনি পাঠককে এই বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। এটি একটি সতর্কতামূলক বার্তা যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি আয়না হিসেবে কাজ করে। ধন্যবাদ কবি জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়ার; বিশেষ করে, ফেসবুকের বাস্তবতা তুলে ধরার জন্য।