কবি ফারহান নূর শান্ত-এর "পাথরে পিষ্ট রূহ" কবিতাটি বর্তমান সমাজের এক নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এটি ক্ষমতা, রাজনীতি এবং মানবিকতার অবক্ষয়ের উপর একটি জোরালো ও স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। কবিতাটি মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
মানবিকতার অবক্ষয়ের ছবি এঁকে কবিতার প্রথম পঙক্তি, "পাথরের নীচে জীবন কাতরায়, কাঁপেনি মানবতা, রক্তের স্রোত -" সমাজের সংবেদনশীলতার অভাবকে তুলে ধরে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে মানুষের কষ্ট এবং রক্তপাত দেখেও সমাজের বিবেক নাড়া খায় না, যা এক ভয়াবহ চিত্র।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির বলতে গিয়ে কবি লিখেন, "চাঁদার দাবীতে, রূহ কেড়ে নিলো ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, ভাবো নির্বোধ" - এই পঙক্তিগুলো ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি এবং তাদের লোভের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনহানিকে নির্দেশ করে। কবি ক্ষমতাকে 'ক্ষণস্থায়ী' বলে তাদের নির্বুদ্ধিতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রসঙ্গে লিখেন, "রাজনীতির কষাঘাতে পিষে মরে লোক, নীতি নৈতিকতা গিলে খায়" - এই অংশে রাজনীতি কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে নিষ্পেষিত করে এবং নীতি-নৈতিকতাকে গ্রাস করে, তা স্পষ্ট। এটি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মানবিক মূল্যবোধের বিসর্জনকেও বোঝায়।
"কাকে হারালো, কে ছেড়ে গেল পরিবারই সেটা বুঝতে পায়" - এই পঙক্তিগুলো হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির পরিবারের অসহায়ত্ব এবং গভীর শোককে তুলে ধরে। যেখানে সমাজ উদাসীন, সেখানে পরিবারের কষ্টই সবচেয়ে তীব্র।
মৃত্যু ও জীবনের মূল্য প্রসঙ্গে শাশ্বত বাণী তুলে আনেন কবিতায়, "মৃত্যু নিশ্চিত সবাই জানি, স্বাভাবিক মৃত্যু কজনের জোটে ? মানুষ কেবলই আঙুলের ছাপ, হিসেব করে ওরা নির্বাচন - ভোটে।" - এই লাইনগুলো জীবনের অনিশ্চয়তা এবং সমাজের চোখে মানুষের মূল্যহীনতাকে ফুটিয়ে তোলে। রাজনীতিতে মানুষ কেবলই ভোটের সংখ্যা, ব্যক্তিগত সত্তা বা জীবনের কোনো মূল্য নেই।
"দেশটা কিন্তু তোমার আমারই, নিছক এত বিদ্বেষ কেন ?" - এই প্রশ্নটি সমাজে বিদ্যমান অনর্থক বিভেদ এবং বিদ্বেষের উপর আলোকপাত করে। কবি মনে করেন, এই দেশ সবার, তাই বিভাজন অনর্থক।
কবিতার শেষ পঙক্তি, "আজ হোক বা কালই হয়তো, সাড়ে তিন হাতে যাবোই জেনো।" - এটি জীবনের নশ্বরতার একটি চিরায়ত সত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে ক্ষমতা বা অর্থের পেছনে ছুটে লাভ নেই, কারণ শেষ পর্যন্ত সবার গন্তব্য একই।
কবিতার শিল্পগুণ সম্পর্কে বলতে গেলে বলা যায়, কবিতাটি সহজ এবং স্পষ্ট ভাষায় লেখা, যা এর বার্তা সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়। এতে কোনো জটিল রূপক বা দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, যা এর আবেদনকে সর্বজনীন করে তুলেছে। প্রতিটি পঙক্তিই শক্তিশালী এবং আবেগপূর্ণ, যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
সর্বোপরি, "পাথরে পিষ্ট রূহ" কবিতাটি একটি সমাজের দর্পণ, যেখানে মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত, রাজনীতি কলুষিত এবং জীবন মূল্যহীন। এটি পাঠকদের নিজেদের সমাজের দিকে তাকাতে এবং এই অবিচার ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে উৎসাহিত করে। এটি একই সাথে ক্ষমতালোভী ও দুর্নীতিপরায়ণদের প্রতি একটি কড়া সতর্কবার্তা এবং জীবনের নশ্বরতার স্মারক। কবি ফারহান নূর শান্ত-এর সর্বাত্মক সুফল্য কামনা করছি।